Ameen Qudir

Published:
2018-02-02 17:30:00 BdST

প্রকৃ্তিও যেন কাঁদছে: এ কান্না ভাষার জন্য, একটি ভাষার মৃত্যুর জন্য


 

 

 

 

 

 


ডা. মোরশেদ হাসান

___________________________


আবার এল ফিরে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আমিও আসছি "মোহিনী মালদ্বীপ" বইটির পর আমার দ্বিতীয় বই "গল্পে অল্প ব্যাকরণ" নিয়ে। পাণ্ডুলিপি শেষ পর্যায়ে। আর সামান্য একটু ঘষা-মাজা। ঘষামাজা-আশকারা-মাসকারা ছাড়া মানুষই চলে না! সেক্ষেত্রে বইকেও তো একটু দিতেই হয়।

শুভানুধ্যায়ীদের নেক-নজর প্রার্থী। অনেকটা দিশি ভোট স্টাইলে, নইলে নিজের বেবাক বই নিজেই কিনে ফেলব।
বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। আমি বলি, বই পড়ে কেউ নিঃশেষ হয় না; সময় করে তবুও পড়ুন --এই লেখাটি বইতে থাকবে।

 


মানুষের মৃত্যু ঘটে। ভাষার আবার মৃত্যু ঘটে কীভাবে? হ্যাঁ; ভাষারও মৃত্যু ঘটে বইকি। এ পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ছয় হাজারের মতো ভাষার অস্তিত্ব আছে। এর মধ্যে আবার অধিকাংশ ভাষারই কোন লিখিত রূপ নেই, এরা শুধুই মৌখিক ভাষা। যেসব ভাষার লিখিত রূপ নেই এদেরই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কোনো বিলুপ্তপ্রায় ভাষার শেষ কথক ব্যক্তিটির যখন মৃত্যু ঘটে তখন তার দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটে। ওই নির্দিষ্ট ভাষাটিতে কথা বলার আর কোন মানুষ রইল না এ পৃথিবীতে এবং যেহেতু ভাষাটির কোন লিখিত রূপ নেই তাই ভাষাটি নিয়ে আর কোন নতুন গবেষণার সুযোগও থাকে না।

ধারণা করা হচ্ছে আগামী একশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ছয় হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় তিন হাজার ভাষার মৃত্যু ঘটবে। অর্থাৎ প্রায় পনের দিনে একটি ভাষার, এক মাসে দু’টি ভাষার এবং প্রতি বছরে চব্বিশটি ভাষার মৃত্যু ঘটবে। বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীদের বাঁচানোর জন্য সারা পৃথিবীতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে দু’একটি প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটলে অসুবিধা কোথায়? এ প্রশ্নে আঁতকে উঠবেন বেশিরভাগ মানুষ। কারণ এটি পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রশ্ন, প্রাণীজগতের ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্ন। ঠিক তেমনি কোন ভাষার মৃত্যু ঘটলে আমাদের প্রিয় এ পৃথিবীও বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এবং এ ক্ষতি অপূরণীয়। একটু লক্ষ করা যাক, যাঁদের বয়স এখন ষাট-সত্তর বছর তাঁরা জানেন তাঁদের মা-চাচিরা অসংখ্য খনার বচন, শ্লোক মুখে মুখে বলতে পারতেন। এর চাক্ষুষ সাক্ষী তাঁরা নিজেরাই। সেই প্রজন্মের মানুষদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অনেক খনার বচন হারিয়ে গেছে যা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হয়নি। তাই ভাষাকে রক্ষায় ভাষাবিজ্ঞানীসহ সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

গত পাঁচশ বছরে ঔপনিবেশিক শাসনামলেও হারিয়ে গেছে অনেক ভাষা। এবং ঠিক একই কারণে লুপ্তপ্রায় আছে অনেক ভাষা। এটি ঘটে তিনভাবে।
প্রথম পর্যায়ে ঔপনিবেশিক দখলদাররা তাদের প্রভাবশালী ভাষাটি চাপিয়ে দিয়েছিল অধিকৃত জাতির ওপর। এই পর্যায়ে স্থানীয় ভাষাটি অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে স্থানীয় অধিবাসীরা দ্বিভাষিকতার আশ্রয় নেয়।
তৃ্তীয় পর্যায়ে, পরাধীন জাতিগুলোর অনেকেই পরবর্তী প্রজন্মে এসে হারিয়ে ফেলে নিজেদের আদি অকৃত্রিম মাতৃভাষা। ঠোঁটে তুলে নেয় ঔপনিবেশিক প্রভুর ভাষা।
একটি বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করছি। ভাষাবিজ্ঞানী ব্রস রাসেল ১৯৯৫ সালে মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন ক্যামেরুনের ম্যাম্বিলায়। কাজের একেবারেই শেষ পর্যায়ে রাসেল হঠাৎ করেই সন্ধান পান বগন নামের এক ব্যক্তির। বগনের বয়স তখন আশি বছরের ওপরে। এক কালের শক্তপোক্ত গড়নের মানুষটি বয়সের ভারে তখন ন্যুব্জ প্রায়। হাঁপানির টান আছে বগনের। একবার হাঁপানির টান উঠলে অনবরত কাশতে কাশতে জান শীর্ণ খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়।

ভাষাবিজ্ঞানী রাসেল স্তম্ভিত হয়ে পড়েন যখন তিনি জানতে পারেন এই বগন হচ্ছে আফ্রিকান কাসাবেও ভাষায় কথা বলতে পারা সর্বশেষ জীবিত ব্যক্তি। রাসেলের জন্য আরও হতাশার ব্যাপার ছিল পরদিনই ছিল তাঁর দেশে ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট। রাসেল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ছয়মাস পর তিনি আবার ফিরে এসে বগনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং কাসাবেও ভাষা নিয়ে কাজ করবেন।
পুনরায় ফিরে আসতে আসতে রাসেলের ছয় মাসের জায়গায় এক বছর লেগে গেল।

এয়ারপোর্টে নেমেই দেরি করলেন না; সোজা রওয়ানা হলেন বগনের আস্তানায়। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বগনের ক্ষুদ্র কুটিরে একটি দীপশিখা কেঁপে কেঁপে ক্ষীণ আলো ছড়াচ্ছে। খড়ের বিছানার ওপর শীর্ণকায় বগন শুয়ে আছে। প্রচণ্ড কাশির দমকে বুকটা হাপরের ন্যায় ওঠানামা করছে। দেখেই বোঝা যাছে শেষ সময় এসে গেছে; যে কোনো সময় প্রাণবায়ু খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
রাসেল কুটিরে ঢুকে বিছানার পাশে বসে বগনের হাত ধরে। অতি কষ্টে রাসেলকে চিনতে পেরে বগনের চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে। হাত ইশারায় কাছে ডাকে…ফিসফিস করে বলে,
ইকি ওনাকো কুউ অঁকে…বগনের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়।
রাসেল হতভম্ব হয়ে বসে আছে। তার হাতে তখনো বগনের নিস্পন্দ শীর্ণকায় হাতটি ধরা। রাসেলের কানে ধ্বনিত হতে থাকে বগনের বলা শেষ অচিন কথাটি। রাসেল নিজেও জানে না তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে আঁধার আরও ঘনীভূত হচ্ছে। প্রকৃ্তিও যেন কাঁদছে।
এ কান্না ভাষার জন্য, একটি ভাষার মৃত্যুর জন্য।

 

--------------------------------

লেখক ডা. মোরশেদ হাসান ।
Works at Medical College, Assistant Professor.
Past: Works at Ministry of Health, Maldives and ICDDR,B

Image may contain: 1 person

 

আপনার মতামত দিন:


নির্বাচন এর জনপ্রিয়