Ameen Qudir

Published:
2017-12-23 17:36:50 BdST

কী এমন ঘটেছে যাতে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের এমন ক্রমাবনতি হয়েছে


 

 

 

 

 

ডা. রেজাউল করীম
পশ্চিমবাংলার প্রখ্যাত লোকসেবী চিন্তক, কলামিস্ট।

____________________

 

আমার বয়স তখন খুব কম। সেবার বাবার শরীর বেশ খারাপ। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। গাঁয়ের একমাত্র ডাক্তারের কোন মেডিকেল ডিগ্রি নেই। কয়েক বছর ঢাকা তে মেডিকেল পড়ে পরীক্ষা না দিয়ে চলে আসেন। রাত বিরেতে তিনিই ভরসা।

বেশি বাড়াবাড়ি হলে ১০-১২ কিমি দূরে সরকারী হাসপাতাল। বর্ষাকালে গ্রামের রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত, পুকুর গুলোও ছাপিয়ে যাচ্ছে। বাবার জন্য ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি ঘনঘন। তিনি ওষুধপত্র দিচ্ছেন। তার'পরে ভরসা করে সবাই ধৈর্য্য ধরে আছে। ডাক্তার খুব চেষ্টা করছে- এরপর যা হবার হবে। ভগবান যদি মারে মানুষ কি করতে পারে!! আজ চল্লিশ বছর পর পেছন পানে তাকাতে গেলে একাধারে ভীত ও চমকিত হই। ভীতির কথা আগে বলি- বাবার যে অসুখটি হয়েছিল, তার নাম ইন্টারমিটেন্ট কমপ্লিট হার্ট ব্লক- সেটা ধরা পড়ল আরো ১২-১৩ বছর পর। অথচ, ডাক্তার জানতেন কিনা জানিনা, অন্তত আমাদের জানাননি। যে ওষুধটি দিতেন তা হৃদস্পন্দন বাড়াতে সাহায্য করতো।

চমক লাগে এই কথা ভেবে যে কত গভীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক ছিল যা অমলিন ও অটুট রাখার জন্য কোন অতিরিক্ত বলের দরকার হয় নি। এখনো গ্রামে গন্জে যে অসংখ্য অপাশ চিকিৎসক আছেন তাদের সাথে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক একই রকম আছে-পাশ করা চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক বিগত চারদশকে পরিবর্তন হলেও তার বিষাক্ত ছায়া এই সম্পর্কে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি।


প্রশ্ন হল- কী এমন ঘটেছে যা রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের ক্রমাবনতি হয়েছে? বা অন্যভাবে বললে- কেন অপাশ চিকিৎসকদের সাথে তার রোগীদের সম্পর্কের অবনতি হয় নি?

অপাশ করা চিকিৎসকদের কিছু সুবিধা আছে। তারা গ্রামের বা এমনকি শহরের প্রায় একই আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন। তাদের পারস্পরিক আস্থা কোন তাৎক্ষনিক বা সাময়িক সম্বন্ধজনিত নয়। দ্বিতীয়ত: তারা সাধারনত: যেসব রোগ ব্যাধির চিকিৎসা করেন তা অনেকাংশে নিরাময়যোগ্য ও চিকিৎসার খরচটিও তারা খুব বেশি বলে মনে করেন না।


দেশের আপামর দরিদ্র মানুষ চিকিৎসককে সমাজ বন্ধু ও বিপদের দিনে নিজেদের সহায় ভাবতে চান। প্রতিচি ট্রাস্ট বীরভূম জেলায় ও ঝাড়খণ্ডের দুমকায় একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন। সে সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে সাধারন অসুখে রোগীদের প্রথম পছন্দ অপাশ চিকিৎসক। কাছাকাছি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তারা যান যখন গ্রামীন চিকিৎসক তাদের সারাতে পারেন না। ফলে তাদের চিকিৎসার সর্বমোট খরচটি কিন্তু বেড়ে যায়। তাহলে আমরা বুঝলাম যে, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পারস্পরিক আস্থা অর্জন।

 

পাশ করা চিকিৎসক যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিন্যাস থেকেই আসুন না কেন তিনি তার অধীত বিদ্যা প্রয়োগ করতে চান পেশাদারের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকাংশে যন্ত্র-নির্ভর। সদ্য পাশ করা ডাক্তারটি যদি তার শৈশব কৈশোরের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারেন তাহলে মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য তাকে আলাদা পরিশ্রম করতে হয় না কিন্তু কম চিকিৎসকের পক্ষেই এই কাজটি করা সম্ভব হয়েছে। আমার সহপাঠি রামেশ্বর মুখার্জি ডাক্তারী পাশ করে একটি মাইক্রোস্কোপ ও একটি স্টেথোস্কোপ সঙ্গী করে ত্রিশ বছর আগে বাঁকুড়ার তার নিজের গ্রামে ফিরে গেছিল। আজ সে এলাকার নাম করা চিকিৎসক ও সত্যিকারের সমাজ-বন্ধু। চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের ভীতিকর অবনতির যুগে সে নিজের এলাকায় প্রায় রামরাজত্ব স্থাপন করেছে। আমি নিজেও আমার গ্রামে বেশ কিছুদিন রোগী দেখেছি- বিশাল সংখ্যক মানুষ এসেছেন তাদের নানারকম সমস্যা নিয়ে। অনেকে সেরে গেছেন, অনেককে সারাতে পারি নি কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্ক সেখানে অটুট ছিল।

 

আমরা এমন বলছি না যে চিকিৎসককে তার জন্মভূমিতে ফিরে যেতেই হবে, নাহলে তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবেন না। আস্থা অর্জনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হল: সহানুভূতি পূর্ণ সহৃদয় ব্যবহার ও রোগীর প্রতি অখণ্ড মনোযোগ ও তার সমস্যাটি তার মতো করে বোঝার চেষ্টা করা। চিকিৎসক অনেক ক্ষেত্রে তা ইচ্ছা থাকলেও করতে পারেন না। প্রথমত: সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে রোগী-চিকিৎসকের গড় অনুপাত হল প্রায় ১:২০০০। চিকিৎসক রোগী পরস্পরের সাথে বাক্যালাপের সময়টিও অত্যন্ত সীমিত। গড়ে একজন চিকিৎসক রোগী পিছু এক মিনিট সময় পান। ফলত: তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। রোগীকে ভালভাবে পরীক্ষা না করেই উপসর্গ অনুসারে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। বাড়তি অনেক অপ্রয়োজনীয় ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। উল্টোদিকে রোগী-চিকিৎসক প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার আগেই সম্পর্কের ইতি হয়। উচ্চ দাম হওয়াই প্রয়োজনীয় কিন্তু দামী ঔষধ অনেক সময় কেনা হয় না। অসুখ সারে না বা জটিলতা তৈরী হয়। সম্পর্কটি বিষিয়ে যায়।

 

রোগী ও চিকিৎসকের সম্পর্কটি দাঁডিয়ে আছে পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার উপরে। মানুষ স্বচ্ছন্দে ডাক্তারের ছুরির সামনে গলা পেতে দিতে পারেন, কারন তিনি জানেন যে চিকিৎসক তার গলার কাঁটাটুকুই শুধু সরিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলবেন। চিকিৎসককে ভগবানের সঙ্গে তুলনা করার অনুষঙ্গের জন্ম এভাবেই। কিন্তু, চিকিৎসক আবার একজন পেশাদার মানুষ, তার ঘর সংসার প্রতিপালন করার জন্য, সংসার বৈতরনী জন্য পারানির কড়ি লাগে। সে কড়ি ভগবান কে নিতে হবে ভক্তের পকেট থেকে। অর্থ অতি বিষম বস্তু। একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে- সরকারী হিসেব- যে প্রতি বছর চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে পাঁচ শতাংশ মানুষ, মানে সারা দেশে প্রায় ৬ কোটি মানুষ, নতুন করে দরিদ্র হচ্ছেন। এদেশে যেমন আম্বানী, আদানীদের মত বড়লোক আছেন তেমনি হত দরিদ্র মানুষ আছেন। তাঁরা শেষ সম্বলটুকু তাদের প্রিয়জনের জন্য রেখে যেতে চায়। কিন্তু চিকিৎসার খরচ মেটানো যখন তাদের ক্ষুধার অন্ন কেড়ে নেওয়ার নামান্তর তখনই বাধে গোলমাল। প্রশ্ন হল কে দেবে এই অর্থ?


আমাদের শাসকরা স্বাস্থ্য ব্যক্তিগত দায়িত্ব বলে জনগনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দেন। শুধু এখন নয়- এ আমাদের অনাদিকালের সংস্কৃতি। চানক্য নাগবংশ ধ্বংস করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে সিংহাসনে বসিয়ে ছিলেন। সাম্রাজ্য পরিচালনায় তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রশংসা করা হয়। তিনি নানা বিষয়ে খুব কার্য্যকরী একটি বই লেখেন- অনেকটা প্রিন্সের মত, কিন্তু অনেক বেশি মেধা সম্পন্ন- তা বর্তমানে তার সংক্ষিপ্তসার যেটি টীকা সহ প্রায় ৭০০ পাতার বই- সেখানে স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন আলোচনাই নেই। এই হল শাসকের মানসিকতা- ভিষগাচার্য্য একজন থাকতেন, তিনি রাজবৈদ্য, রাজা ছাড়া অন্যের চিকিৎসা তার দায়িত্ব নয়।আম জনতার স্বাস্থ্য তাই অবহেলিত থেকে গেছে। সময় পাল্টেছে, যুগের সাথে বিশ্ব পাল্টেছে কিন্তু আমরা পাল্টাই নি। ইউরোপে অনেক দেশে নিয়ম তান্ত্রিক রাজা আছেন, রাজতন্ত্র ও আছে কিন্তু জনগনের স্বাস্থ্য রক্ষায় তারা সদা তৎপর। সরকারের সারা বছরের যা আভ্যন্তরীন উৎপাদন তার শতকরা ৬-১০ ভাগ স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় হয়। এদেশে সেই পরিমান ১.২%। অতীতে আমাদের গড় আয়ু কম ছিল- আমাদের ব্যক্তিগত চাহিদা বলতে ছিল এদেশের আবহমানের সংস্কার মেনে সব অন্যায় অবিচার নিয়ে ঈশ্বরের কাছে নালিশ, আর ফরিয়াদ।


অথচ, আমরা কিন্তু আর শান্ত তপোবনের যুগে পড়ে নেই- বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের উন্মেষ হয়েছে, ত্যাগে মোক্ষলাভ কিম্বা সম্পদ ও দারিদ্র শ্রীভগবান পাদপদ্মে সমর্পন করার জন্য আর তেমন সাড়া পাই না। ঈশ্বরকে বিজ্ঞান খুঁজে দিতে পারে না তাই অচলা ভক্তিতে খামতি পড়ছে। এই সময়ে স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে কিন্তু আয় বাড়ে নি। সরকার স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় করে না, হাসপাতাল বাড়ে নি, যখন অসহায় শিশু তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন কার কাছে ফরিয়াদ করবো?

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে রোগী আর চিকিৎসকের যে স্বাভাবিক ও "পবিত্র" সম্পর্ক তার মাঝখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অদৃশ্য শক্তি আছে- সে হল সরকার, যার কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ আছে, যার হ্যান্ডনোটকে আমরা অর্থ বলে জানি। সেই অদৃশ্য শক্তিই সবচেয়ে শক্তিশালী। আগে যেমন ছিল অদৃশ্য ভগবান, এখন তেমনি সরকার। এখানে রোগী ও চিকিৎসক দুপক্ষের কাছেই তিনি সমান গুরুত্বপূর্ণ। দুজনেই দাবী করতে পারে- তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি। এদেশের মানুষ যে ছটি রোগে সাধারণত মারা যান তার বেশির ভাগই জনস্বাস্থ্য ঘটিত সমস্যা- যার দায়ভার অনেকাংশে সরকারের।


শিক্ষা, পানীয় জল, পুষ্টি, বাসস্থান ইত্যাদি সরকার যেগুলির দায়ভার নেবে বলে ঘোষনা দিয়েছে সেগুলি পর্যাপ্ত ভাবে সম্পাদন করতে পারলে নিশ্চয়ই এত রোগে প্রানহানি আর বিপুল সম্পদের এত অপচয় হত না। বিশেষত শিক্ষার কথা একটু আলাদা উল্লেখের দাবী রাখা। ইউনিসেফ শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ বলে ঘোষনা দিয়েছিল। এখানে শিক্ষা বলতে এম সি কিউ মুখস্থ করার কথা হচ্ছে না। শিক্ষা মানে যা মনের প্রসার ঘটায়, যা মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর স্বাভাবিক স্ফুরন ঘটায় সেই শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। সেই শিক্ষা সক্ষমতা বাড়ায়, মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব উদ্যোগ আয়োজন লাগে, যা দিয়ে সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে পারা যায়, আলো থেকে অন্ধকার, সত্য থেকে মিথ্যাকে আলাদা করা যায়- তার নাম শিক্ষা। সেই শিক্ষা আনে সচেতনতা আর সচেতনতা আনে রোগ থেকে মুক্তি, কুসংস্কার থেকে মুক্তি- সামগ্রিক ভাবে জীবনযাত্রা উন্নততর করতে কাজে লাগে সে শিক্ষা। একটা রিপোর্ট বের করেছেন প্রতিচি ট্রাস্ট- শিক্ষা নিয়ে ওনারা কাজ করেন- সেখানে দেখা যাচ্ছে যে একজন রোগী একই রোগের জন্য যা খরচ করেন সে ক্ষেত্রেও শিক্ষার মূল্য আছে- গরীব নিরক্ষর আদিবাসীর চিকিৎসা ব্যয় শিক্ষিত বা স্বাক্ষর আদিবাসী মানুষের চেয়ে বেশি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যার যত আয় কম তুলনায় শতাংশ হিসেবে তার চিকিৎসা খরচ বেশি।

 

বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে আরো আলোচনা করলে এটা ধীরে ধীরে বোঝা যাবে যে রোগী আর ডাক্তারের সম্পর্কে নিয়ন্ত্রন করার মালিক এরা নন, এরা হলেন পুতুল নাচের পুতুল , যে রথের রশি আছে অন্যের হাতে। সে সবল লোমেশ হাত হল রাষ্ট্রের হাত। রাষ্ট্রের কাজ হল বিরোধ কমিয়ে আপাত সমন্বয় তৈরী করা যাতে সংঘাত কমে। তারা বিবাদমান শ্রেনীর মধ্যে সংঘাত কমিয়ে দিতে সচেষ্ট কিন্তু সে সমন্বয় মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা না মিটিয়ে হলেও শাসকের কিছু যায় আসে না। তাই, তারা খুব সুকৌশল মিথ্যাচার করে নিজের ভাল প্রমান করার চেষ্টা করে। কথায় আছে- তিনরকম জিনিস নিয়ে আমরা কারবার করি- সত্য, মিথ্যা ও তথ্য। সত্য আর মিথ্যাকে তথ্য দিয়ে গুলিয়ে দেওয়া যায়।তাই তথ্যের অধিকারের সপক্ষে আইন করে পার্লামেন্টে কিন্তু পুষ্টির অধিকার বা স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য আইন নেই। তাই ডেঙ্গু হলে সরকার বলে আমরা মুম্বাইয়ের চেয়ে ভাল- ওদের ছশো মারা গেছে, আমাদের ৩৪। আপনি একটি নম্বর-৬৯ঙ বা এরকম কিছু। হিরে খনিতে কাজ করুন আর কারখানায় লোহা পেটান সেখানে আপনার প্রাপ্য হল যেটুকু না পেলে আপনি মরবেন না সেটুকু। বাকি মুনাফা যাবে শেঠেদের হাতে বা তাদের কর্মচারীর হাতে। সেই কর্মচারীদের ওরা পার্লামেন্টে পাঠায়, নিজেদের সুবিধা মতো আইন তৈরী করিয়ে নেয়।

 

প্রশ্ন হল- এই যে সরকার নামক জগদ্দল রেফারী রোগী আর ডাক্তারকে গজকচ্ছপ লড়িয়ে দিচ্ছে আর নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁডিয়ে মজা দেখছে কি করে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মুক্তির সহজ সরল কোন রাস্তা নেই। কিন্তু কিন্তু যৌক্তিক দাবী পূর্ন হলে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি দূর করা সম্ভব। সরকারের অধুনা লুপ্ত পরিকল্পনা কমিশন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সরকারকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার সেই পরিকল্পনা গ্রহন করে নি। সেখানে বলা হয়েছিল- সরকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩-৩.৫% করবে, সবার জন্য অভিন্ন, সমমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। কাউকে এর জন্য বাড়তি খরচ করতে হবে না। ধনী দরিদ্র বিভাগ করা হবে না। প্রকৃত পক্ষে উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরী করে সেখানে সরকারের পরিচালকদের ও চিকিৎসা হবে এটাই বান্ছনীয়। রাজাদের জন্য তৈরী খাবার রাঁধুনিকে খাওয়ানটাই সবচেয়ে ভাল পন্থা। সর্বজনীন স্বাস্থ্যে অনেক সময় নানাভাবে ফড়েরা ঢুকে পড়ে ইন্সুরেন্স নিয়ে। বেসরকারি ইন্সুরেন্স যেন নাক গলাতে না পারে তার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরী করার কথা বলা হয়। আরেকটি ভাল দিক হল- এই খরচ তোলার পদ্ধতি ও কমিশন বাতলে দিয়েছিল। এতদিন স্বাস্থ্য সেস বা ঐ ধরনের কোন ইনডিরেক্ট ট্যাক্স দিয়ে স্বাস্থ্য খরচ তোলার পরিকল্পনা করা হয়। এদেশে খুব কম মানুষ ডাইরেক্ট ট্যাক্স দেয়। তাদের উপর সামান্য ট্যাক্সেও যে বিপুল অর্থ উঠে আসতো তা দিয়ে অতি সহজেই এই কর্মসূচি রূপায়ন করা যেত। কিন্তু সরকার এই দাবী মানে নি।

 

রোগী চিকিৎসক সম্পর্ক উন্নতি করবার যে সহজতম পথটি ছিল সেটা অতএব বাতিল। দীর্ঘ্য জটিল পথ তাই পেরোতে হবে। আমি নিজে বিশ্বাস করি পরিকাঠামো উন্নয়ন করে রোগীদের আরেকটু ভাল পরিষেবা জরুরি কিন্তু একই ভাবে জরুরী হল মানুষের আস্থা অর্জন করা। আস্থা অর্জনের জন্য দরকার নিজেদের মানুষের প্রতিদিনের বেদনায় সমব্যাথী হওয়া, তাদের দাবী দাওয়ায় শরিক হওয়া। উন্নাসিকতার গজদন্ত মিনার ছেড়ে উন্মুক্ত সরনীতে তাদের সম পর্যায়ে দাঁড়াতে হবে। তার প্রাথমিক ধাপ হতে পারে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবীতে পথে নামা। মানুষের এই দাবী চিকিৎসকদের ভেতর থেকে উঠে আসতে হবে। যদি চিকিৎসক সন্ত্রাস মুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা চান তাহলে সবার জন্য সমমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা রচনা করতে হবে। এ রামায়নের সত্যিকারের বাল্মীকি হতে পারেন চিকিৎসকরা- তারা তাদের অধীত জ্ঞান দিয়ে জানেন চিকিৎসার অতীত ভবিষ্যত। স্বাস্থ্যের মত বৃহৎ আন্দোলনে তারা যদি নেতৃত্ব দিতে পারেন তাহলে সম্পর্ক সহজ হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য যদি রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সমাজের অন্য অংশীদারের মত তারাও সেখানে নিজেদের মত জানানোর সুযোগ পাবেন। ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত চিকিৎসকদের কাছে এ একটি বড় সুযোগও- নিজেদের সমাজ বন্ধু হিসেবে পুন:প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার সবাইকে করতে হবে- চিকিৎসক ও রোগীর সার্বিক ঐক্যই পারে হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করে চিকিৎসককে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে।

আপনার মতামত দিন:


নির্বাচন এর জনপ্রিয়