Ameen Qudir

Published:
2019-02-13 22:54:29 BdST

ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক কারণ ও প্রতিকার



ডেস্ক
_____________________

লেখাটি ড. আকতার বানু আলপনার । তিনি অসাধারণ ভাবে ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক কারণ ও প্রতিকার সুন্দরভাবে লিখেছেন। এই লেখার যত প্রচার ও প্রসার, ততই জনসচেতনতা তৈরী হবে । সেজন্য লেখাটি প্রকাশ হল।

ড. আকতার বানু আলপনা_____________

এ সময়ের একটি আলোচিত ঘটনা- গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য ডেকে নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ। আসামিদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গত ৫ এপ্রিল বুধবার দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার দারুল তালিম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও কাচারীপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মুফতি মতিউর (৫০) তার মাদ্রাসার এক ছাত্রকে ধর্ষণ করার পর স্থানীয় জনতা তাকে পুলিশে দেয়। ধর্ষণের ভয়াবহতা যে কতটা ব্যাপক তা আমরা জানি। জানি না এটি কি পরিমাণে রোজ ঘটছে। কারণ ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা দেয়া হয়। যেমন- এই প্রিন্সিপাল ও ইমাম ইতোপূর্বে একাধিক ধর্ষণ বা রেপ করলেও তার কোনো শাস্তিই হয়নি। আমরা জানতেও পারিনি। বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটি ঘটনা মিডিয়াতে এলে আমরা দু’চার কথা বলি। তারপর যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে জানার, কেন মানুষ রেপ করে? এর প্রতিকারই বা কি?

আসুন জানি, রেপের মনস্তাত্তি¡ক কারণ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে।

রেপের কারণসমূহ:

১. অপরাধী মানসিকতার লোকেরা খুব সহজে, বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকার কারণে নির্দ্বিধায় রেপসহ যে কোনো অপরাধ করতে পারে, করে। এটি রেপের প্রধান কারণ।

২. আমাদের দেশের পুরুষরা বিয়ের আগে সেক্স করতে পারে না সমাজের নিষেধের কারণে। সবার প্রেমিকা থাকে না, থাকলেও পূর্ণ তৃপ্তির সুযোগ থাকে না। পতিতালয় আছে। সেখানে যাওয়ার মানসিকতা, সুযোগ, সামর্থ্য সবার থাকে না। পরকীয়া বা রেপ করাও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু শরীরের চাহিদাটা থেকে যায় মোক্ষমভাবেই। ফলে তারা সুযোগ খোঁজে। যে কোনো মেয়ে, শিশু এমন কি অতি কাছের কোনো আত্মীয়কে একা পেলে রেপ করে।

৩। ধর্ষকদের মধ্যে কাম প্রবৃত্তি ( বা অন্যকে নির্যাতন করে যৌনসুখ লাভের মানসিকতা) থাকতে পারে, থাকে যা রেপের আরেকটি কারণ।

৪. সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকেরা রেপ করে। ধারাবাহিক রেপের কারণও এটি।

৫. মাদকাসক্তি মানুষের স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ লোপ করে। এটিও রেপের আরেকটি কারণ।

৬. ধর্ষকদের মনে মেয়েদের প্রতি তীব্র অশ্রদ্ধা, ক্রোধ, আক্রমণাত্মক মনোভাব ও প্রতিহিংসা পরায়ণতা (যার কারণ হতে পারে অতীতে কোনো মেয়ে দ্বারা প্রতারিত, অপমানিত প্রত্যাখ্যান হওয়া, ইত্যাদি), থাকলে তারা রেপ করে।

৭। একাকিত্ব বোধ, অক্ষমতাবোধ, রাগ, অপমানজনক অনুভূতি, হতাশা, ব্যর্থতা বা ব্যক্তিজীবনে কষ্ট, অপ্রাপ্তি এসব থাকলে ধর্ষণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায়।

. যে সমাজে দ্ব›দ্ব ও সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য বলপ্রয়োগ বা প্রচণ্ডতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, সে সমাজে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে। তাই সামাজিক প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের অভাব রেপসহ সব ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী।

৯. যেসব পর্নোচিত্রে মেয়েদের সঙ্গে জবরদস্তিমূলক যৌন সম্ভোগে মেয়েদের তা উপভোগ করতে দেখানো হয় বা মেয়েদের প্রতিবাদ করতে দেখানো হয় না, সেসব দেখে অনেক পুরুষ রেপে উৎসাহিত বোধ করে।

১০. কোনো মেয়ে প্রেমে বা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে রাজি না হলে মেয়েটির ‘না’- কে সহ্য করতে না পেরে রেপ করে।

১১. মেয়েদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতাও রেপের অন্যতম কারণ। কখনো কখনো রেপকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, বিশেষ করে যুদ্ধের সময় রেপকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে যুগে যুগে দেশে দেশে। যেমন- ব্রাউনমিলার (ইৎড়হিসরষষবৎ, ১৯৭৫) তার বইতে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে বিজেতারা বিজিতদের শাস্তি দিতে বা ভয় দেখাতে ধর্ষণকে রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছে। একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডররা ইউরোপের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের সময় জেরুজালেমকে মুসলমানদের দখলমুক্ত করার সময় প্রচুর রেপের ঘটনা ঘটে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়ামের মহিলাদের, আমেরিকান সৈন্যরা ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালানোর সময় ভিয়েতনামী মহিলা ও বালিকাদের, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের মেয়েদের, সার্বীয় সৈন্যরা বসনীয় মেয়েদের, ১৯৯০ সালে কুয়েত দখলের পর ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতি মেয়েদের রেপ করে। এখনো কাশ্মির, আফগানিস্তান, সিরিয়া, বার্মা, এসব দেশে প্রচুর রেপ হয়।

১২. ক্ষমতাশীল ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় রেপের মাধ্যমে।

১৩. কখনো কখনো বন্ধুবান্ধবরা একসঙ্গে হয়ে বা শক্তিশালী হয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য রেপ করে। ইত্যাদি।

হুজুরদের (এমনকি হাফেজদের) দ্বারাও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের রেপড হওয়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। মাদ্রাসার বা এতিমখানার কোমলমতি অসহায় শিশুগুলোর ওপর বর্বর নির্যাতন করলেও হুজুরদের বিরুদ্ধে সহজে কেউ মুখ খোলে না বলে তারা এসব জঘন্য অপরাধ করতেই থাকে। তারা কেন রেপ করে? উত্তর হতে পারে এরকম-

১. তাদের দাম্পত্য জীবনের যৌন অতৃপ্তি কখনো কখনো রেপের কারণ হতে পারে। ২. মাদ্রাসার বা এতিমখানার আবাসিক পরিবেশ, অভিভাবকদের অসহায়ত্ব ও হুজুরদের প্রতি তীব্র আনুগত্য হুজুরদের সাহস বাড়ায়। ফলে তারা এমন অপকর্ম করতে ভয় পায় না। ৩. ধর্মীয় অনুশাসন ভাঙার ইচ্ছা কখনো কখনো রেপের কারণ। ৪. আমরা বিভিন্ন মুসলিম দেশের, বিশেষ করে সৌদি আরবের মানুষদের জীবনপ্রণালি অনুকরণ করি। তারা যেহেতু বহুগামী এবং যৌন জীবনে খুবই অসংযমী, তাই আমরাও তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করি। ৫. ধর্মীয় আইনের ভুল ব্যাখ্যাও দায়ী। অনেক হুজুর মনে করে, আল্লাহর কাছে তওবা পড়ে মাফ চাইলেই বা হজ করলেই যে কোনো পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এমন ধারণাও রেপের জন্য দায়ী। ৬. ধর্মীয় বাধার কারণে হুজুররা সহজে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না, পতিতালয়ে যেতে পারে না, প্রকাশ্যে প্রেম করতে পারে না। ফলে তাদের অবদমিত যৌন চাহিদার কারণে কখনো কখনো তারা ছেলেদের রেপ করে। ৭. অসহায় শিশুগুলোর ওপর জুলুম করা সহজ। কারণ এরা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে দুর্বল। তাই ভয় দেখিয়ে বা জোর করে এদের রেপ করা যায়।

রেপের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:

প্রতিটা শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো তার বাড়ি, তার পরিবার। এটিই তার আচরণ, মূল্যবোধ, ধারণা, বিশ্বাস, নৈতিকতা, সাহস, শিক্ষা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এই ভিত্তিই তার সারা জীবনের আচরণের মূল চাবিকাঠি। এখান থেকে সে যা শিখবে, সারাজীবন সে তাই করবে। পরিবারে সে ভালো কিছু শিখলে সে ভালো হবে, না হলে খারাপ। তাই ছোটবেলা থেকে আমাদের উচিত আমাদের শিশুদের প্রতিবাদ করতে শেখানো। কখনো যেন তারা কোনো অন্যায় মেনে না নেয়। তাহলে তারা ভয় পাবে না, কিছু গোপন করবে না, সাহসী হবে, যে কোনো অন্যায়ের শুরুতেই প্রতিবাদ করতে শিখবে। এটা খুব জরুরি। আরো জরুরি শিশুকে নিজে অন্যায় না করতে শেখানো যাতে বড় হয়ে সে নিজে যেন অপরাধী না হয়।

পরিবারের উচিত, এ রকম যে কোনো জঘন্য অপরাধ গোপন না করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। এই প্রিন্সিপালের করা প্রথম রেপের শাস্তি হলে পরের রেপগুলো সে করতে পারত না। এ বিষয়ে এলাকাবাসীরও সচেতন থাকা দরকার। কারণ সেখানে তাদের বাচ্চারাও পড়ে। তাদের বাচ্চারাও এমন অপরাধের শিকার হতে পারে।

মাদ্রাসা বা এতিমখানাগুলোতে এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তাই অভিভাবকদেরও উচিত সচেতন হওয়া।

অপরাধীরা শক্তিমান হলেও ওসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের উচিত সম্মিলিতভাবে এসব অপরাধীদের প্রতিহত করা।

মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি কম। আর এই সুযোগটাই নেয় কিছু জানোয়ার। তাই নজরদারি বাড়াতে হবে।

সর্বোপরি, হুজুর বা অহুজুর, অপরাধ যেই করুক, এ রকম বিকৃত মানসিকতার শিক্ষকদের তথা এমন সব অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

রেপের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা :

কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে তার কাছের জনেরা তাকে সাহায্য করুন, চিকিৎসা দিন, মানসিক শক্তি জোগান। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ভুলতে সাহায্য করুণ। কিছু করতে না পারলে অন্তত মন দিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে তার কষ্টের কথা শুনুন, সমব্যথী হোন। ভিকটিমকে সান্ত¡না দিন। বলুন যে দুর্ভাগ্যজনক হলেও এমন ঘটনা আরো অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। দরকার হলে পরিবেশ বদলানো দরকার। এতে ঘটনার তীব্রতা কম অনুভূত হয়। পজিটিভ ভাবতে সাহায্য করুন। যাই ঘটুক, তাকে কাটিয়ে ওঠে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিন। সর্বোপরি, প্রতিবাদ করার জন্য মানসিক শক্তি জোগান ও প্রতিবাদের উপায় দেখিয়ে দিন, সঙ্গে থাকুন।

কেন রেপসহ যে কোনো অপরাধের প্রতিবাদ ও প্রতিকার হওয়া জরুরি। অন্যায়ের প্রতিকার না পেলে মানুষের মনে যে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তা সারাজীবন তাকে কষ্ট দেয় যার যন্ত্রণা শুধু সেই জানে। অন্যায়ের প্রতিকার না পেলে বা প্রতিবাদ করতে না পারলে তা মানুষের মনের ওপরে চাপ ফেলে, মানুষ নিজেকে অপমানিত বোধ করে, ওই কষ্টকর বা অসম্মানজনক অবস্থার কথা ভুলতে পারে না। ফলে স্বাভাবিক ও আনন্দময় জীবন ব্যাহত হয়। নিকটজনদের তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার করতে না পারার অপরাধে কখনো ক্ষমা করতে পারে না। কোনোদিন শ্রদ্ধা করবে না। আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক শক্তি, ক্ষমতা বা সৃজনশীলতা, কাজ করার স্পৃহা, জীবনে কিছু করার বা হওয়ার স্বপ্ন, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ এগুলো চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। কেউ কেউ অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। কেউ না মরে বেঁচে থাকে।

অপরাধীকে বুক উঁচিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে দেখে ভিকটিমের কষ্ট আরো বাড়ে। অপরাধী শাস্তি পায় না বলে আরো অপরাধ করার স্পর্ধা ও সুযোগ পেয়ে যায় এবং বীরদর্পে অপরাধ করে। তাকে দেখে অন্যরাও অপরাধ করতে উৎসাহিত বোধ করে। আরো মানুষ অপরাধ করে। এভাবে সমাজ, দেশ কলুষিত হয়।

ভিকটিম ন্যায়বিচার না পাওয়ার কারণে আত্মগøানিতে ভোগে, নিজেকে অসহায় ও অপরাধী ভাবে, আত্মহত্যা করে, কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, মানুষের প্রতি আস্থা হারায়, অনেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়। ভিকটিমের মনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট, ভয়, লজ্জা, আতঙ্ক, ঘৃণা ইত্যাদি সৃষ্টি হয় যা তাকে প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণা দেয়।

মানুষ স্বভাবগতভাবে ন্যায়পরায়ণ। তাই তার প্রতি ঘটে যাওয়া অপরাধ দগদগে ঘায়ের মতো চিরস্থায়ীভাবে থেকে যায় যা কোনোদিনও শুকায় না, ভিকটিম কখনোই তা ভুলতে পারে না। অপরাধী শাস্তি পেলে ভিকটিম সান্তনা পায়, কষ্ট চলে যায়, নতুন করে বাঁচার উদ্যম সৃষ্টি হয়, মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসে।

আমরা আশার করেেবা সমাজে সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক, যেখানে কোনো অপরাধীই অপরাধ করে পার পাবে না।

ড. আকতার বানু আলপনা : সহযোগী অধ্যাপক, আইইআর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়