Ameen Qudir

Published:
2018-12-09 22:05:50 BdST

কখনোই মনে হয়নি আত্মহত্যা করি


 

 

অধ্যক্ষ মাসুদ আলম বাবুল
___________________________________

ছোটোবেলা শীতের সকালে রৌদ্রে পড়তে গিয়ে চলে যেতাম তেপান্তরের মাঠে বা বিলের ভিটায়। পুরনো ছাতার জাঙ্গা দিয়ে সিটকে বানিয়ে মাছরাঙা, বকপক্ষি ধরার জন্যে ওঁৎ পেতে একরকম ক্রলিংয়ের মতো করে কোনো গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতাম। বাবা থাকতেন চট্রগ্রাম, কিন্তু ছুটিতে বাড়িতে আসলে অন্যসব কাজের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্ববহ ছিলো আমাকে দেখে নেয়া। একবার এরকম একটি সেমি এমবুসিং ক্রিড়ায় আমাকে খপ করে ধরে ফেলে কখনো চুলের মুষ্টি, কখনো ঘাড়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মক্তবের হুজুরের কাছে। বললেন, শুধু হাড্ডি কয়খান চাই, ও তো আমার পোলা না, একটা বান্দরের হাড্ডি।
বাবা চলে যাবার পর হুজুর তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে নারকেলের সুঁচালো তেল চকচকে খোসা বা চাড়াটা বের করে টেবিলের উপর রাখলে সারা শরীর আমার কাঁটা দিয়ে উঠতো।

হাতের লেখা খাতা ও বাড়ির অংক করিনি বলে মোশারেফ স্যারের জোড়া বেতের পিটুনি আজও যেনো শ্রদ্ধাভরে মনেপড়ে। টিকা নেবোনা বলে ইট দিয়ে স্কুলের জানালার সিক ভেঙে পালানোর অপরাধে হেডমাষ্টার তাজেম স্যার ঘন্টার পর ঘন্টা কান ধরে তপ্তরোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখিছি অন্য সহপাঠীরা আমার দিকে বক্রদৃষ্টিতে ফিরে ফিরে ভর্ৎসনার হাসি হেসে ক্লাসে যাবার দৃশ্য। দিন পনের সৌম্য শান্ত ছাত্রের মতো চলতে থাকলেও মার খাবার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সহপাঠী বন্ধু মন্টু, শাহালম, রাজ্জাক, সিদ্দিক, লালমিয়া, টুনুর সাথে কোন রাতে কার খোপের হাস চুরি করে পিকনিক করা হবে সে মিটিংএ সভাপতিত্ব করার কৃতিত্ব অর্জন থেকে বঞ্চিত হতাম না।

স্কুলে নাটক করার কথা বলে স্থানীয় যাত্রাদলে অভিনয় করতে যাবার কথা শুনে সকালে অপেরার গ্রীণ রুম থেকে ডেকে শুধু সকলের সামনেই নয়, ড্যান্সার রিনার সামনেই বাবা আমার পিঠে ছাতার ডাট ভেঙেছে।

স্কুলের একটি অনভিপ্রেত ঘটনায় যখন সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ধর্মঘট ডেকেছিলাম তখন আমার চাচা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক শত শত ছাত্র-ছাত্রীর সামনে আমাকে পিটিয়ে স্কুলের সামনের পুকুরে ফেলে দিয়েছিলো, সাঁতরে অন্যপারে উঠে সিক্ত বসনে লজ্জায় লাল হয়ে যখন বাড়িতে গিয়েছি তখন মায়ের হাতে আবার মার খেতে হয়েছিলো। কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করতাম বলে আমার ধর্মপ্রাণ বাবা আমার হাতে কোরান শরীফ তুলে দিয়ে শপথ করতে বলেছিলো, আমি যেনো আর ছাত্র ইউনিয়ন না করি। বাবার কথা রাখতে না পারায় আমাকে মৌখিক ভাবে ত্যাজ্য ঘোষণা করে এবং সকল লেখাপড়ার খরচ না দেবার শপথ করেন। বরিশাল এসে লজিং টিউশনি করেও জীবন নির্বাহ করতে হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে যশোর বোর্ড থেকে হাতে টুকে আনা রেজাল্ট সিটে আমার রোল ভুলক্রমে না আসায় ভুল ভাঙার মাঝখানের দীর্ঘ একটি মাস কতো মানুষের কতো কথা, কতো গঞ্জনা শুনেও বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করেছিলো। কখনোই কেনো যেনো একবারের জন্যেও মনে হয়নি আত্মহত্যা করি। আজকাল শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা এতো বেশি বেড়ে গিয়েছে যে যা রীতিমত ভাবনার বিষয়। শিক্ষক কর্তৃক অনুশাসন, পরীক্ষায় কাঙ্খিত রেজাল্ট না হওয়া, মা-বাবার প্রতি রাগ অভিমানে প্রতিনিয়তই শিশু কিশোরদের আত্মহত্যার খবর শুনে যাচ্ছি। যা আগে কখনো শোনা যায়নি। তাই, নিজের সন্তানের সাথেও একটু রাগারাগি করলে স্ত্রী সাবধান করে দেয়, দিনকাল কিন্তু ভালো না।
ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রীর প্রতি চরম অন্যায় করেছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা, একথা শ্বীকার করতেই হবে। তবুও কেনো যেনো মনেহচ্ছে একই ঘটনা পঁচিশ বা ত্রিশ বছর আগে হলে এমনটা মনেহয় হয়তোবা হতোনা।
ইভটিজিং ও ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাগ থেকে টাকা চুরির অপরাধে আমার কলেজ থেকেও ক'জন ছাত্র-ছাত্রীকে অভিভাবক ডেকে টিসি দিয়ে দিয়েছিলাম। তারাও অনেকবার ক্ষমা চেয়ে ধরাধরি করে অনুকম্পা প্রার্থনা করেছিলো। আমরা চূড়ান্তভাবেই অভিভাবকদের কাছে বিনয়ের সাথে আমাদের অপারগতার কথা ব্যক্ত করেছি। ভাগ্যিস ওরা কেউই লজ্জা ও অপমানে আদিষ্ট হয়ে অত্মহননের পথ বেছে নেয়নি, তাই আমি এখনো স্বপদে আছি, বলতে গেলে ওদেরই কৃপায়।
তবুও প্রশ্ন একটাই, কেনো এতো আত্মহনন প্রবনতা শিশুমনে, খতিয়ে দেখা দরকার এখনি, নইলে সামনে যে সমূহ বিপদ।
জানতে পেরেছি অরিত্রীর গ্রামের বাড়ি আমার বাড়ির কাছাকাছি তাই বলে নয় একজন স্কুল পড়ুয়া কিশোরীর এভাবে অকালে ঝরে যাওয়ায় আমিও দারুণভাবে ব্যথিত। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম নিয়মনীতি পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনাই যদি হয় এমন অপরাধের জন্যে টিসি দেয়া সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের অন্যথা করার সুযোগ কোথায়?
আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত আসামি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে বিচারক তার আদেশের ব্যত্যয় করেন না, যতোক্ষণ পর্যন্ত তার কলম সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
যতোটা জানি অভিভাবকগণ ভিকারুন্নেসার কঠোর নিয়মনীতির উপর আকৃষ্ট হয়েই লক্ষ লক্ষ টাকা ডোনেশন দিয়ে একজন গর্বিত অভিভাবক হন। এ নিয়মনীতিই তাদের ব্যবসার পুঁজি। যার বলি হয়তোবা অরিত্রী হয়েছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে বুঝতে পারলে অবশ্যই শিক্ষকরা অরিত্রীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেন না। কাজেই আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে কথাটা ঠিক নয়। মা-বাবা পাড়া প্রতিবেশীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েও অনেকে অতী আবেগে এমন কান্ড করে বসে। কাজেই সবকিছু বোঝার চেষ্টা করা উচিত আমাদের, এ শিক্ষকদেরও পরিবার পরিজন সমাজ সভ্যতা আছে। একটি আত্মহত্যার ঘা ঢাকার জন্যে পুরো জাতির যাতে আত্মাহুতি না ঘটে, সে দিকটাও না হয় ভাবুন একবার।
অরিত্রীর আত্মার শান্তি কামনা ও অনেক ভালোবাসায়-
_________________________________

মাসুদ আলম বাবুল । কথাশিল্পী।
অধ্যক্ষ
হাজী আক্কেল আলী হাওলাদার (ডিগ্রি) কলেজ
পটুয়াখালী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়