Ameen Qudir

Published:
2018-11-11 17:05:52 BdST

সড়ক দুর্ঘটনায় আয়নাল ডাক্তারের ছেলের মৃত্যু এবং আরেকটি মেয়েকে জীবন দান


লেখকের ছবি।


ডা সুরেশ তুলসান
_______________________________


সড়ক দুর্ঘটনা ও একটি কবিগান।-- আমার এক শৈশবস্মৃতি।
---------------
সড়ক দুর্ঘটনা - টিভির সামনে বসেন, পত্রিকার পাতা উল্টান, রেডিও চালু করেন ( যদিও এখন প্রায় অপ্রচলিত), নেট চালু করেন -- একটা খবর আপনাকে সবার আগে বিরক্ত করবে এবং আপনার মনখারাপ করবে এবং তা হলো সড়ক দুর্ঘটনার খবরগুলো। যেন সচরাচর ঘটে যাওয়া কিছু। যেন মনেহয় রোজকার ডালভাত।
সড়ক দুর্ঘটনার খবরগুলো এখন কেমন করে যেন এমনই সহনীয় পর্যায়ে এসে গেছে।

একটা সময় ছিলো যখন দেশে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতো না।
বড় রকমের কোন সড়ক দুর্ঘটনা ছিল একেবারেই কদাচিৎ ।
বড় কোন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় প্রাণহানি হলে তা দেশের সমগ্র মানব সত্ত্বাকে নাড়া দিতো।

পাবনা জেলার শাহাজাদপুর থানার বাঘাবাড়ি ঘাটে ঘটে যাওয়া তেমনই এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ প্রান হারান।
সেই দুর্ঘটিনার স্মৃতিতেই কোন এক নাম না জানা কবি গানের একজন লেখক, সুরকার, গায়ক একটি কবি গানের রচনা করেছিলেন, এবং সুর দিয়েছিলেন এবং গেয়েছিলেন।

ছোটছোট ছাপানো পুঁথির আকারে এবং মানুষের মুখেমুখে সেই গান দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে ছিল।

সময়টা কখন,কত সাল (১৯৭৪-৭৫ হতে পারে), আমার তখন বয়স কত, আমার শৈশবকাল না বাল্যকাল, কোন শ্রেণীতে পড়ি, এসবের কোন কি কিছুই ঠিকঠাক মনে নেই।
শুধু মনে আছে আমার ছেলেবেলার এক খেলার সাথী আর তার মুখ থেকে গানে গানে শোনা এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা করুণ বর্ননাচিত্র।
সেই সড়ক দুর্ঘটনার করুন বর্ননা আমার শিশু মনে এমন এক সুগভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যা এই আজও আমি কোনভাবে মুছে ফেলতে পারি নাই।

নাম দীপালি সর, ঘেরওলা ফ্রক আর ঘটি প্যান্ট পড়া আমারই সমবয়সী একটি ছোট্ট মেয়ে। মাথার দুপাশে ফিতা দিয়ে বেণী করা, মোটা মোটা ডাগড় ডাগর চোখ।
খুব অল্প সময়ের জন্য আমার এক খেলার সাথী।
ওর কাকু, কার্তিক সর, এডরুক নামক এক ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ, কুষ্টিয়াতে পোস্টিং, আমাদের অনেক বড় বাড়ীর নীচতলায় ভাড়া থাকতেন।

সে তার কাকুর কাছে এসেছিল মাত্র কিছু দিনের জন্য, হয়তো স্কুলের কোন এক অবকাশে।
সে আমাদের বাড়ীতে আসার কিছুদিন পুর্বে পাবনা জেলার অন্তর্গত শাহাজাদপুর থানার বাঘাবাড়ী ঘাটে যাত্রী বোঝাই একটি বাস ফেরীতে উঠার সময় বাসের কন্ডাকটর যাত্রীদের বাস থেকে নেমে যাওয়ার অনুরোধ করলে যাত্রীরা নামতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বাধ্য হয়ে যাত্রী বোঝাই বাস নিয়েই ফেরীতে উঠার সময় বাসটি যাত্রী সহ ফেরী থেকে নদীর পানিতে পড়ে যায় এবং অনেক অনেক যাত্রী প্রাণ হারান।

কবি গানটি মুলত সেই দুর্ঘটনারই একটি করুন শিল্প চিত্র।

অনেক দিন ( প্রায় ৪৩-৪৪ বছর ) আগে শোনা। গানটি অনেক বড় ছিল। এই সেদিনও প্রায় পুরোটাই মনে ছিল। এখন খুব সামান্যই মনে আছে।

সেইটুকুই এখানে তুলে ধরলাম।
--------------------------------------------

""প্রথমে আল্লা বলি কলম তুলি ভাবিয়া খোদায়,
পাবনা জেলার অন্তর্গত শাহজাদপুর থানায়,
ঘটনা বাঘাবাড়ি।
ঘটনা বাঘাবাড়ি,
পারের ফেরি ঘাটে বান্দা রয়।
বগুড়া হইতে গাড়ী যখন আসিয়া দাঁড়ায়,
নদীর উত্তর পাড়ে।
নদীর উত্তর পাড়ে কন্ডাকটরে জোড়হাত কইরা কয়,
ফেরীতে উঠাইবো গাড়ী নাইমা যান সবাই,
কেহ নামতে চায়না।
কেহ নামতে চায়না,
কথা কয়না এহইলো ক্যামোন ?
কেহ বলে পয়সা দিয়া নামবো কি কারন ?
সবাই জেহাদ করে।
সবাই জেহাদ করে,
গাড়ীর পরে বসিয়া রহিলো- ---
ভর্তি মোটর লইয়া যখন
ফেরীতে উঠাইলো,
বেরেক মিস করিয়া।
বেরেক মিস করিয়া ---
লম্ফ দিয়া পড়িলো যখন,
গাড়ীর মধ্যে ছিল যারা কি হইলো তখন,
আমায় রক্ষা করো,
আমায় রক্ষা করো,
হস্ত ধরো পাড়েতে উঠাও,
কোথায় রইলা প্রানের পতি,
কোথায় আমার মাও,
আমায় রক্ষা করো।
আমায় রক্ষা কর,
ডাংগায় তুলো,
বাড়ী পৌছে দাও,
আমার জন্য কাইন্দা পাগল হইবো আমার মাও--
আমায় রক্ষ করো।

এর পর আর মনে নেই তবে মাঝের দুইটা লাইন মনে আছে

আইনাল ডাক্তার নামে লোকটি বাঁচাইলো প্রাণ,
তাহার বড় ছেলে।
তাহার বড় ছেলে,
লোকে বলে,
নামে শাজাহান,
বাঘাবাড়ী ঘাটে আইসা হারাইলো প্রান ----
তাহার বড় ছেলে।

অনেকদিন আগে শোনা। পরের অংশটুকু আর মনে নেই। মনে নেই সেই ছোট্ট মেয়েটার নাম যাকে আইনাল ডাক্তার প্রানে বাঁচান।
তবে এটুকু মনে আছে এই পুঁথি গানের এই মেয়েটির পরিবারের সকলেই এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
আইনাল ডাক্তারের বড় ছেলে যদিও এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় তাপরও তিনি এই মেয়েটিকে প্রানে বাঁচান এবং নিজের বাড়ীতে নিয়ে যান এবং লালনপালন করেন।
আইনাল ডাক্তার আর এই ছোট্ট মেয়েটির মধ্যকার পরবর্তী সম্পর্কটাই এই কবিগানের মুল প্রতিপাদ্য।

_________________________
ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়