Ameen Qudir

Published:
2018-11-01 16:39:59 BdST

পরিবহন নৈরাজ্য: আমরা যাব কোথায়


 



মিহির রঞ্জন তালুকদার
_________________________________
আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত লোকদের পাবলিক বাসে যাথায়াতই প্রধান ভরসা। আর যারা পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন তাদের অবশ্যই কোনো না কোনো কারনে একান্ত অনিচ্ছা সত্তে¡ও ড্রাইভার কিংবা হেল্পারের সাথে তর্ক বিতর্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে। শেষে মানসম্মানের ভয়ে হার মেনে বসে থাকতে হয়। তারা না বুঝে আইন, না বুঝে মানবতা, না বুঝে যুক্তি, না বুঝে মান-সম্মান। এ কারনেই জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলে গেছেন ‘মূর্খের সাথে তর্ক করা বোকামি’। কিন্তু তারাপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তর্ক না করে থাকা যায় না। দ্বিতীয়ত নিজে করি শিক্ষকতা তাই উপদেশ দেওয়াটা বোধ হয় রক্তের সাথে মিশে গেছে। তবে এদের উপদেশ দেওয়া মানে তাদের সাথে তর্কে জড়ানো। যদি বলি ভাই একটু আস্তে গাড়ি চালান, বলবে আরে এত ভয় পান তাহলে গাড়িতে উঠলেন কেন? এ কথা শুনার পর সীটে বসে বসে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। আর চিন্তা করি হে ঈশ্বর বাসের ৪০-৪৫ জন যাত্রীর জীবন এখন কার কাছে!
ভাগ্যক্রমে যদি ড্্রাইভারের পাশের সীট পেয়ে যাই তবে তাদের সাথে একটু খাতির জমানোর চেষ্টা করি। গত কয়েক দিন আগের ঘটনা। আমি সিলেট থেকে দিরাই যাচ্ছি ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সীটে বসে। গাড়ি চলন্ত অবস্থায় ড্রাইভারের সাথে কথা বলা উচিৎ নয়। কিন্তু এ রাস্তার ড্রাইভার একেবারেই ব্যতিক্রম। মনে হয় তারা কথা না বলে, সিগারেট না টেনে গাড়ি চালাতে পারে না। কথা-বার্তা আবার রসিক ধরনের, এদের কথা যদি আপনি এনজয় করতে পারেন তাহলে ভালই সময় কাটাতে পারবেন। যাত্রীদের কোনো অসুবিধা হলো কিনা এটা এদের দেখার বিষয় নয়। ড্রাইভারের দেখা দেখি আবার দুয়েকজন যাত্রীও গাড়িতেই সিগারেট ফুঁেক। আমি একটু চেষ্টা করেছিলাম বারন করতে উল্টু আমাকে বলে আপনার সমস্যা হলে প্রাইভেট গাড়ি করে যান। মনে মনে বললাম যা শালা তুই সিগারেট খা, না বিষ খা আমার কী। আমাকেওত বাসে করেই যেতে হবে। ভগবান সবাইবে প্রাইভেট গাড়িতে চড়ার সামর্থ্য দেয় না।
আমার লেখার ধরন দেখে আপনারা মনে করবেন আমি মনে হয় ‘এ জার্নি বাই বাস’ রচনা লিখছি। কারন মূল গঠনা এখনও শুরু হয়নি। গঠনা শুনার পর আপনার শুধু এতটুকুই অনুধাবন করতে পারবেন যে, প্রতিদিন আমাদের জীবন নিয়ে তারা কীভাবে চিনিমিনি খেলে। গাড়িটি পাগলা বাজার অতিক্রম করার পরই হঠাৎ হার্ড ব্রেক। অনেক যাত্রীই আঘাত পেয়েছে এবং ড্রাইভারকে গালিগালাজও করছে। আমিও কপালে সামান্য আঘাত পেয়েছি, সামনে থাকার কারনে ব্রেক করার আগ মূহুর্তেই প্রস্তুত ছিলাম তাই আঘাত কম পেয়েছি। সামনে একটি ছাগল ছিল তাকে বাচাঁতেই হার্ড ব্রেক। তখন ড্রাইভার বলছিল
‘শালা গরু-ছাগলই আমাদের বড় সমস্যা বুঝলে ভাই। এখানে যদি মানুষ থাকত তা হলে ব্রেক না করেই চলে যেতাম।’

বললাম কী বলেন এইসব।
বলল ভাই গরু-ছাগল মারলে সাথে সাথে আমাদের জরিমানা গুণতে হয়, কিন্তু মানুষ মারলে আমাদের আর পায় কে? গাড়ি রেখে পালাব। পরে পাবলিকে গাড়ি পুড়িয়ে দেবে মালিকও বীমা কোম্পানী থেকে নতুন গাড়ি নিয়ে নেবে। অর্থ্যাৎ গাড়ির বীমা করা আছে দূর্ঘটনা ঘটলে বীমা কোম্পানী নতুন গাড়ি দেবে।
ড্রাইভারদের কাছে এই হচ্ছে মানুষ এবং গরু ছাগলের পার্থক্য। সুপ্রিয় পাঠক শুনার পর নিশ্চই গালে হাত দিয়ে বসে পরছেন? কী শুনলাম এসব, আমিও বাকরুদ্ধ হয়ে সারাপথ চুপ করে বসে রইলাম আর কোনো কথা বললাম না।

৪৮ ঘন্টার পরিবহন ধর্মঘটে, পরিবহন শ্রমিকদের যে বর্বরতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে আমরা কোনা সভ্য দেশে আছি বলে মনে করছি না। সাধারণ মানুষ এবং ছাত্রীদের হয়রানি, লঞ্ছনা ছিল চোখে পরার মতো। স্কুল ছাত্রীর যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল সেটা দেখলে যে কোনো সুশিল লোক তাদের ধিক্কার দেবে। সাদা ধব ধবে স্কুল ড্রেস পরিহীত ছাত্রীটি নির্ভাক হয়ে দাড়িয়ে আছে। হয়ত গত কালই তার মা স্কুল ড্রেসটি ধোয়ে ইস্ত্রি করে মেয়েকে পরিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তারা এই সুন্দর পোশাকটির গায়ে পোড়া মবিল লাগিয়ে দিল। ছবিটি দেখে মনে হলো মেয়েটি হয়ত কান্নাই ভুলে গেছে এই অবস্থায়। সেই মেয়েটি কারো না কোরো মেয়ে কারো না কারো ছাত্রী। এদের হাত থেকে বাদ যায়নি প্রাইভেট কারের ড্রাইভারসহ মটরসাইকেল আরোহীও। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজত আছেই।
হরতাল, ধর্মঘটের সাথে আমরা বেশ আগে থেকেই পরিচিত। কিন্তু রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স সর্বদাই এর আওতামুক্ত ছিল। কিন্তু এদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি ৭ দিন বয়সি শিশুটিও। ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’ কী করব আমরা এসব অঙ্গীকার করে। যে শিশুটির এখনও নামকরনি করা হয়নি তাকেই আমরা বাচঁতে দিলাম না। এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কী কোনো সাজা নেই? এরা কী খুনি নয়?
আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী আমাদের জীবন এই সন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দেব কী না। একটি গাড়ির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন ড্রাইভাবের হাতেই তাকে। সে যদি মানুষের মূল্য না বুঝে। গরু ছাগলকে মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান মনে করে তার কাছে কী গাড়ির স্টিয়ারিং দেয়া উচিৎ?
এদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বিধান বাতিল, এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি করা, ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক পতিনিধি রাখা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ ইত্যাদি।
এসব দাবিগুলো আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে যে, তারা খুন করে খুনের বৈধতা চাচ্ছে। দেশ যখন শিক্ষা দীক্ষায়, প্রযুক্তিতে এগিয়ে চলেছে সেখানে ড্রাইভারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি রাখার কোনো যুক্তিই নেই। তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা যদি জামিনযোগ্য হয় তাহলে তারা আইনের উর্দ্ধে চলে গেল। দুর্ঘটনার প্রধান কারনগুলিই হচ্ছে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব, নেশাগ্রস্থ, খামখেয়ালি জীবন যাপন ফলে অন্যের জীবনের মূল্য তারা বুঝবে কী করে?
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা হলো যারা সত্যিকার ড্রাইভার তারা এই আইন সম্পর্কে কিছু জানেও না, বুঝেও না। যদি এদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে (অধিকাংশেরই নেই) তবে কাগজে কলমে পঞ্চম শ্রেণি পাশ, প্রকৃত পক্ষে তারা নামও লিখতে পারে না। কিছু কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তারা পত্রিকা যেমন পড়তে পারে না দেশের কোনো খবরা খবরই এদের প্রয়োজন পরে না। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো তারা ধর্মঘট ডাকল কেন? মূল কথা হলো তাদেরকে দিয়ে ধর্মঘট ডাকানো হয়েছে। তাদেরকে উল্টা পাল্টা বোঝানো হয়েছে। এদের মুল হোতারে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
________________________________


লেখক
মিহির রঞ্জন তালুকদার : প্রাবন্ধিক ও প্রভাষক, বালাগঞ্জ সরকারি কলেজ, বালাগঞ্জ,সিলেট।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়