Ameen Qudir

Published:
2018-09-07 16:39:55 BdST

শোক এপিটাফএকটি কাতল মাছ কেনার সুখস্মৃতি : সব ঝাপসা হয়ে আসছে , কবির


অকাল প্রয়াত ডা. ইকবাল আমিনুল কবির

 

 

ডা. খায়রুল ইসলাম
__________________________________

আমি মূলত মফস্বলের মানুষ; টাংগাইল জেলার ভুয়াপুর উপজেলার গারাবাড়ী গ্রামে আমার জন্ম। ঢাকার বাইরেই বড় হয়েছি। ঢাকা শহরে বেড়াতে এসেছি মাঝেমধ্যে; লেখাপড়ার জন্য থেকেছি হোস্টেলে - মিটফোর্ড এলাকায়। ১৯৮৫ তে ইন্টার্নশীপ শেষ হতেই ঢাকায় বসবাসের পালা শেষ হয়ে গেল। প্রথম চাকুরিস্থল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ী ইউনিয়নের স্বাস্থ্য উপ কেন্দ্রে; সপরিবারে থাকতে শুরু করি কালিহাতীতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ঢাকায় আসি ১৯৮৭ সালে; নিজ বাসায়। পারিবারিক সম্পত্তির তালিকায় উল্লেখ করার মধ্যে ছিল একটি পুরোন খাট (উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া), একটি চৌকি (নিজ অর্থে কেনা), একটি স্টিলের আলমারি এবং নায়লন ফিতার চেয়ার টেবিল সেট (এখন বিলুপ্ত)। এই নিয়ে ঢাকায় আসা; ঢাকা মানে কমলাপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে মুগদাপাড়ায়।

কালিহাতী থাকতে প্রতিদিন বাজারে যেতাম দুটি কারনে; আমাদের কোন ফ্রিজ ছিলনা – কাজেই দিনের বাজার দিনেই করতে হতো; আর অন্য আকর্ষণ ছিল তাজা মাছ। বড় মাছ সব ঢাকা চলে আসতো; দুয়েকটা মাছ যাও উঠতো তা কেনার সামর্থ্য আমার ছিলনা। ছোট্ট জায়গা; জেলেরাও তা জানতো। বাজারে যেসব তরতাজা ছোট মাছ উঠতো – তার রূপেই মন ভরে যেত; সামর্থ্যেও কুলাতো। সাতসকালের আলোয় লালমুখো পাবদা আর কিংবা পুটি মাছের চকচকে রূপালী আঁশের মাঝখান দিয়ে বয়ে লালরেখা, টাটকিনি মাছের পিঠে নীলাভায় আমি যেন খুঁজে পেতাম ভৈরবী রাগের রেখাবের রূপ। বড়মাছ বা মাংস কিনতে না পারা, ছেলের ল্যাক্টোজেন ইনফ্যান্ট ফর্মুলা কেনার জন্য বিয়েতে উপহার পাওয়া প্রাইজবন্ড ভাঙ্গানোকে কখনো দারিদ্র বলে মনে হয়নি; বরং জীবনের প্রাসঙ্গিক অনুসঙ্গ মনে হয়েছে।

সেই আমি ঢাকায় এসে প্রথম অনুভব করি অর্থাভাব। মুগদা থেকে হেটে কমলাপুর এসে বাংলাদেশের স্টাফ বাস কিংবা ছয় নম্বর বাসে আসি ফার্মগেট; অথবা শেয়ারে রিক্সায় মুগদা থেকে মালিবাগ; মালিবাগ থেকে টেম্পোতে ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে; খানিকটা হেটে তেজগাঁ কলেজের সামনে থেকে আরেক টেম্পোতে কাজীপাড়ার সমান ভাড়ায় আসি প্ল্যানিং কমিশন। ফেরার পর্বটা আরো কঠিন। আসল কথা, সকালে কিংবা প্রতিদিন আর বাজারে যাওয়া হয়ে উঠেনা। ফ্রিজ কেনাটা ভীষন দরকারি মনে হতে থাকে। সে সময় ১৮৫০ টাকা মূল বেতনে হাজার তিনেক টাকার মতো সাকুল্যে মাসে পেতাম। কোন সঞ্চয় নেই; বাড়িভাড়া দূরে থাক- হাউস বিল্ডিংয়ের কিস্তি বকেয়া জমে যাচ্ছে; তেমনি অবস্থায় এমফিলের সহপাঠী পংকজদার কাছ থেকে ধার নিয়ে কিনি একটা ফ্রিজ। তাতে সপ্তাহে একবার বাজারে গেলে চলে; কিন্তু বাজারে গিয়ে মন ভরেনা। এখনকার বাংলাদেশে শুনতে আজব লাগতে পারে, কিন্তু সেসময় গরীবের মাছ হলো ইলিশ। কতশত মানুষ দেখেছি যারা বলতেন – বেগুন, চিংড়ি আর ইলিশ মাছে এলার্জি আছে। সেসময়ে সেই ইলিশ সম্বল করেই মুগদাপাড়ার মাছের বাজার। নিবারন বলে একজন মাছ ব্যবসায়ী কয়েকটা তিন চার কেজির রুই কাতল আনতো। তখনো মহারাষ্ট্র বা বার্মার রুই বাজারে আসেনি। সেই রুই কাতল কেনার মানুষ নেই; নিবারন তাঁর সুনিপুন হাতে একটা মাছ কেটে আট বা দশ ভাগ করে মাছের ভাগা বিক্রী করতো। মাসের প্রথম দিকে সেরকম “ভাগা” কিনতাম; অনুমান করি তাতে হয়তো আধা কেজি থেকে সাত আটশো গ্রাম মাছ থাকতো। রুইয়ের চাইতে কাতল মাছ কেনার প্রতি ঝোঁক ছিল বেশী; কারন কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমার ছেলে রুই মাছ খেতে চাইতোনা কিন্তু কাতল মাছ খেতো।

এই সময়টায় আমি পরিকল্পনা কমিশনের চাকুরির পাশাপাশি নিপসমে এমফিলের থিসিস পর্বের কাজ করে যাচ্ছিলাম। এমফিল কোর্সে তখন আমার আরেক সহপাঠী ডা ইকবাল আমিনুল কবির। ফর্সা, নায়ক চেহারা, সুন্দর পরিশীলিত বাংলায় কথা বলে। লেখালেখির হাত ভালো। আহমেদ পাবলিশিং হাউস থেকে একসাথে ওর আর আমার বই একবার বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। সবচাইতে বড় ব্যাপার, আমাদের চাইতে অনেক উদার, বিশাল মনের মানুষ। সাংসারিকভাবে আমার মাজুল অবস্থার কথা কবির বোধ হয় জানতো।

একদিন হঠাত কবির বললেন – রাজশাহীর মান্দা থেকে আমাদের বেশ কিছু স্বাস্থ্য কর্মী আসছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় তাঁদের প্রশিক্ষিত করার জন্য সিসিডিবি-এর মীরপুর ১০ নম্বর অফিসে সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষন আয়োজন করা হয়েছে। আমি আধা দিন ছুটি নিয়ে যেন দুটি সেশন নেই। ক্যাডেট কলেজে বক্তৃতা দেবার অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হলো আমি পারবো; আমি রাজী হলাম। কারিকুলাম জেনে নিয়ে কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম মীরপুর ১০ নম্বর অফিসে। আমাকে কবির বলেছিল দুপুরে সিসিডিবিতে লাঞ্চ করতে। খুব চমৎকার লাঞ্চ - সবজি, মাছ, মুরগী, ডাল; একসাথে এত আইটেম কম খেতে পেতাম তখন; খেয়ে উঠে বাইরে দাড়ালাম; এককাপ চা এলো; তাঁদের প্রটোকল অফিসার এসে এক প্যাকেট গোল্ডলীফ থেকে একটা সিগারেট বের করে আমাকে দিলেন; তারপর আলগোছে ভুলে যাওয়ার ভান করে প্যাকেটটা রেখে চলে গেলেন। কবির কখনো সিগারেট খেতোনা, আমি কবিরকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলাম – কি ব্যাপার। মুচকি হেসে বললো – রেখে দেন। চা সিগারেট খেয়ে সেশনে ঢুকলাম; পরপর দুটি সেশন; কিভাবে সময় কেটে গেল জানিনা। বিকাল গড়িয়ে গেছে; ফিরবার পালা। তখনো জানতাম না, বেরিয়ে আসার সময় আবার সেই প্রটোকল অফিসার, একটা কাগজে সই নিয়ে একটা খাম দিলেন। আমি বাইরে এসে খামটা খুলে দেখি ১৫০ টাকা সেশন নেয়ার জন্য সম্মানী বাবদ আমাকে দেয়া হয়েছে। আনন্দে আমার মন তাতা থৈথৈ করে উঠলো। আমি আর টেম্পো চড়িনা; রিক্সায় উঠে সেই প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে কাজী পাড়া হয়ে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছি। পড়ন্ত বিকেলে রিক্সায় একা সিগারেট খেতে খেতে আসার আনন্দ তুলনাহীন।

আনন্দের প্রাথমিক রেশ কাটিয়ে উঠার পর খামটা আমি সযত্নে রেখে দেই। এবার সপ্তাহান্তে ফকিরাপুল বাজারে ঢুকি। মুগদাবাজারের চাইতে ওখানে মাছের প্রকার ও সাইজ অনেক ভালো পাওয়া যেতো। ফকিরাপুল বাজারে গিয়ে একটা সাধ্যমতো সাইজের একটা কাতল মাছ কিনে চাইনিজ কাট দিয়ে কেটে দিতে বলি। চাইনিজ কাট হলো পেট এবং পিঠ একসাথে রেখে মাছটাকে চিরে ফেলে তারপর টুকরা করা। তাতে মাছের টুকরাগুলোর সাইজ বেশ বড় দেখায়। এবার আর মাছের “ভাগা” নয়, পুরো মাছ একসাথে কিনে এনেছি; এর আনন্দই আলাদা। বাসায় এসে আইস্ক্রিমের বাক্সে কয়েকভাগে মাছ তুলে রাখি; আর ফ্রেশ খাওয়ার জন্য কয়েকটা টুকরা বাইরে রাখি। অনেকদিনপর মনের মতো করে মাছ খেলাম।

এরপর কবির জানায়, প্রশিক্ষণার্থীদের মূল্যায়নে আমি প্রশিক্ষক হিসাবে খুব সমাদৃত হয়েছি। আমাকে আরো যেতে হবে। এরপর আরো কয়েকবার গিয়েছি; কিন্তু প্রথমবারের মতো অপার বিস্ময় ও আনন্দ আর কখনো পাইনি। প্রয়োজন ও জীবনের মোহের কাছে পরাস্ত হয়ে এর কিছুদিনের মধ্যে আমি নিজেও সরকারি চাকুরী ছেড়ে এশিয়া ফাউন্ডেশনে চাকুরি নিয়ে ফেলি। সিসিডিবির সেই প্রশিক্ষন হলে আর কোনদিন যাওয়া হয়নি।

এসব ঘটনার প্রায় তিন দশক পার হয়ে গেছে। আজ সকালে আমি বসে আছি ব্যংককের এক চার তারকা হোটেলে; আমাদের রিজিওনাল ফান্ডিং মিটিং। সেলফোনে মেইল চেক করতে করতে দেখি শোক সংবাদ। ইকবাল আমিনুল কবির গত রাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। প্রথমে আমার কিছুই মনে হয়না। বাইরে তাকাই, নীচে গাড়ি বাসের জ্যাম লেগে আছে, স্কাই ট্রেন যাচ্ছে আসছে; আরেকটু দূরে তাকাই, - সাদা নীল মেঘের ভিড়; সীমাহীন আকাশ; মনটা হঠাত উদাস হয়ে যায়। আজ আমার গায়ে ইন্দোনেশিয়ার হাতে কাজ করা বাটিকের শার্ট; পায়ে ইংল্যান্ডের ক্লার্কের জুতা; ব্যাংককে এসে ডিনার করেছি গার্লিক লেমন সসে স্টিম করা তরতাজা রেড স্ন্যাপার দিয়ে। এসব কোন কিছুই এখন আর তেমন কিছু মনে হয়না। কিন্তু এই জীবনে একত্রিশ বছর আগে ফকিরাপুল বাজার থেকে আস্ত কাতল মাছ কেনার আনন্দ এসে আমার বুকের ভেতর ওলট পালট তোলপাড় করে দেয়; সেই সুখস্মৃতি কি করে ভুলি! কি করে ভুলি পাটের দড়িতে ঝোলা আগুনে এক শলা সিগারেট ধরিয়ে খাওয়া মানুষের বুক পকেটে এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট থাকার গর্ব নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে ঢাকা শহরে রিক্সায় ঘোরার আনন্দ! এমন বিরল আনন্দ আমার জীবনে আপনি এনে দিয়েছিলেন, কবির। আপনি হয়তো দেখেছিলেন বুঝেছিলেন বন্ধুর জীবন, কিন্তু আমি দেখিনি এবং বুঝিনি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো আকাশে হঠাৎ মেঘ জমেছে; সব ঝাপসা হয়ে আসছে।

চিরশান্তিতে থাকবেন, কবির।
______________________________

ডা. খায়রুল ইসলাম
Country Director at WaterAid Bangladesh
Former Regional Program Support Manager at Plan International, Region of Eastern and Southern Africa (RESA)
Former Country Director for Bangladesh and Pakistan at Orbis International


Studied Medical Science at Sir Salimullah Medical College,Dhaka

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়