Ameen Qudir

Published:
2018-07-21 18:45:59 BdST

কথাশিল্পী ডা. রাজীব হোসাইন সরকারের লেখা অসাধারণ গল্প



ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
____________________________________

রাস্তায় জমে থাকাপানির উপর একটি নিশান ব্লু বার্ড গাড়ির চাকা আটকা পড়ে গেছে। সাজানো গাড়ি। তাজা ফুল দেখে আন্দাজ করা যায়, বিয়ের গাড়ি। ইঞ্জিন বন্ধ। ড্রাইভার গ্লাস নামিয়ে ঘুমুচ্ছে। আগাম বিপদ সম্পর্কে সে আঁচ করতে পারছে না।
বিপদ প্রথম আঁচ করেছে আতাহার।
আতাহার বসে আছে রাস্তার পাশে মন্টুর চায়ের দোকানে। চায়ের অর্ডার হয়েছে। এখনো আসেনি। চা আসার আগ পর্যন্ত সে টেবিলে দু’হাত রেখে গাড়ির চাকা নিয়ে বিস্তর চিন্তা-ভাবনা করছে। চাকার তলায় গামলা সাইজের পানি জমেছে। লাল মাটি। লাল মাটির ভাবগতি সুবিধের না। দ্রুত পিচ্ছিল হয়। গর্ত হলে তো কথা নেই। সসারসদৃশ চাকা ঘুরবে কিন্তু উঠবে না। পুরাতন গাড়ির চাকায় বীড থাকে না। পিচ্ছিল গর্তে সেই চাকা ঘুরতেই থাকবে। আতাহার একবার চিন্তা করল রাস্তায় গিয়ে সরেজমিনে গাড়ির চাকা পরীক্ষা করবে। বীড না থাকলে ড্রাইভারকে সতর্ক করবে গাড়ি সরাতে। মাটি এখনো সেভাবে ভেজেনি।
মন্টু চা দিয়ে গেল। আতাহার বলল,
‘পরের কাপ রেডি করেন।’
আতাহার সকাল থেকে কিছু খায়নি। বাসার চুলো বন্ধ। মা নেই। একুশদিন থেকে হাসপাতালে। ক্যান্সারের টার্মিনাল স্টেজ চলছে। অগ্ন্যাশয়ে ক্যান্সার। দিনে তিনবার বালিশে বুক চেপে যন্ত্রণায় চেঁচামেচি করে। কেন তিনবার কাঁদে আতাহার সেই রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। সাদা এপ্রোনধারী অল্পবয়সী ইন্টার্নকে জিজ্ঞাসা করেছিল। রুপবতী ডাক্তার তাকে ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছে। তিনবারের রহস্য জানা যায়নি। এ নিয়ে আতাহারের মনে আফসোস নেই। কোন রুপবতী ভ্রু কুঁচকে চমৎকার গুছিয়ে ধমক দিচ্ছে, এটা দেখার মাঝেও আনন্দ।
আতাহার ঘুম থেকে জেগে প্রথমে ভেবেছে প্রথমে হাসপাতালে যাবে। মায়ের অসুস্থতায় বাড়ির চুলোয় হাড়ি না উঠলেও কেবিনে স্টিলের টেবিল ফলমূল ভরে থাকে। দীর্ঘ জীবনে আতাহার যাদের দেখেনি তারাও ব্যাগভর্তি ফলমূল এনে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আতাহারের মাখেতে পারে না। ফল সামনে ধরলে নাকে গন্ধ লাগে। চিৎকার করে বলে, ‘সরা, কুত্তা সরা।’
কুত্তা হল আতাহার। তার মা ভয়াবহ যন্ত্রণা উঠলে তাকে কুত্তা বলে সম্বোধন করে। তার মায়ের কুত্তা ডাক তার নিকট বরাবরই দূর্বোধ্য মনে হয়। আতাহার বেশ কয়েকবার কথাচ্ছলে বলেছে , ‘কুত্তা বলবেন না মা। বাঘ বা পাখি বলবেন। সরা, বাঘ সরা। সরা পাখি, সরা। শুনতেও ভাল লাগে।’
আতাহারের মা কথা শোনেনি। বুকে বালিশ চেপে বলেছে, ‘সর কুত্তা, সর।
আতাহার আধাঘন্টা আগে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতালে যাবে না। মন্টুর ক্যান্টিনে টানা পাঁচ কাপ চা খাবে। পাঁচ কাপ খাবার পক্ষ্যে তার নিজস্ব একটি থিওরি আছে। থিউরির নাম ‘ক্ষুধা নিপাতে পঞ্চ কাপ থিউরি’। থিউরি বেশ সহজবোধ্য। পঞ্চম কাপের প্রথম কাপ চাকিছু বোধগম্য হবার পূর্বেই পাকস্থলীঅতিক্রম করবে। দ্বিতীয় কাপ পাকস্থলীকে কিঞ্চিত উদ্দীপ্ত করবে। তৃতীয় ও চতুর্থ কাপ হল ট্রাম্প কার্ড। হাঙ্গার কিলার কাপ। তাদের মূল আয়োজন থাকবে পাকস্থলী ঘিরে। ক্ষুধা নিবারণ। পঞ্চম কাপ হল রিজার্ভ কাপ। কাপ চতুষ্টয় ক্ষুধা নিবারণ পর্যায় ঠিকঠাক সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে সে একশনে নেমে যাবে।
চা চলবে একটার পর একটা। চায়ের সাথে সিগারেট। প্যান্টের পকেটে এক প্যাকেট সিগারেট থাকার কথা। গোল্ডলিফ। গরম গরম সিগারেট। গতকাল সন্ধ্যায় হাসপাতালের গেটে কেনা।তার মা একশ টাকা হাতে দিয়ে বলেছে ভালোমন্দ কিনে খেতে। আতাহার মন্দ কিনে ফেলল। সত্তর টাকায় কিনল এক প্যাকেট গোল্ডলিফ। দুধ চায়ের সাথে গোল্ডলিফ মধ্যযুগীয় ওয়াইনের গ্লাসে বরফের মত। শ্বাসনালী পথে নিকোটিন যাবে, খাদ্যনালীতে যাবে ক্যাফেইন। দুটোর সংমিশ্রণে একধরণের গা-ঝাড়া ভাব এসে যাবে। গা-ঝাড়া ভাব আসলে সে নীতুর সামনে যাবে। গিয়ে বলবে,
‘তুমি বৃষ্টির দিনে আমার হাত ধরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে। চলো যাই। বৃষ্টি থেমেছে। তবে শ্রাবণের আকাশের ভরসা নেই। যেকোন মুহুর্তে ঝেপে নামবে।’
আতাহার জানে, নিতু ভুরু কুঁচকে বলবে, ‘অবাস্তব কথাবার্তা বলবে না। যন্ত্রণা।’ অবাস্তব ও যন্ত্রণা শব্দ হল নীতুর ট্রেডমার্ক শব্দ। স্বয়ং শহীদুল্লাহ বা সুনীতিকুমারও এই শব্দদ্বয়ের উপর অধিকার খাটানোর ক্ষমতা রাখেন না।
আতাহার প্যান্টের পকেটে হাত দিল। হাত দিয়েই তার মন খারাপ হয়ে গেল। শিকারের সময় কুট্টি আগায় না। তার ক্ষেত্রে ধুম্রপানের সময় সিগারেট আগাচ্ছে না। পকেটে কোন সিগারেট নেই। আস্ত একটা প্যাকেট উধাও। কে নিতে পারে? একসময় রিক্সায় উঠলে নীতু বের করে নিত। দু’হাত দিয়ে কুটিকুটি করে ছিড়ে ফুলের মত উড়িয়ে দিত। নীতু জানে না, আতাহার এই পুষ্পবৃষ্টি দৃশ্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখার জন্য সিগারেটের প্যাকেটে গোল্ডলিফের বদলে স্টার রাখত। দুটো গোল্ডলিফের টাকায় চারটা স্টার হয়। চার স্টারের পুষ্পবৃষ্টি দেখতে তার বেশ আনন্দ লাগত।

গাড়ি এখনো চালু হয়নি।
বর কনে না উঠলে সে যেতে পারবে না। রাস্তার উল্টোদিকের দোতলা নীল রঙ্গের বাসাটাতে বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের উপলক্ষ্যে গেট চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। গেটের দুইপাশে দুটো মাঝারী সাইজের ক্রিসমাস ট্রি। বিয়েবাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি লাগানোর বুদ্ধিটা কীভাবে আসল সে বুঝতে পারছে না। ট্রির গা জুড়ে মরিচবাতি। দিনের আলোয় বাতির আলো ততটা ফুটছে না। ডেকোরেশন পরিকল্পনা যে করেছে তাকে ধরে এনে দুকাপ চা খাইয়ে কষে কয়েকটা থাবড়া বসিয়ে দেওয়া যেত। এরপর প্যাকেট করে পাঠানো হত নীতুর কাছে। নীতুর বিবাহ পরিকল্পনার একটি অতিক্ষুদ্র বয়ান শুনে পরবর্তী বিবাহে সে ডেকোরেশন করত।
বিবাহ নিয়ে নীতুর বিস্তর পরিকল্পনা আছে। ডায়েরীতে লাল, নীল ও হলুদ রঙে বিভিন্ন পরিকল্পনা তালিকাবদ্ধ করা আছে। লাল তালিকার প্রাধান্য বেশি। ফরজে আইন। অবশ্য পালনীয়। নীল নির্ভর করবে হাতের উপর। অর্থকড়ি থাকলে পালিত হবে। হলুদ গুরুত্বপুর্ণ নয়। সময়ের সাথে পরিবর্তনীয়। বিবাহের আগে যদি মনে হয়, করা যায়, তখন ভেবে দেখা যাবে।
লাল তালিকায় প্রথম তিনটি আতাহারের স্মরণ আছে। নীতু পরিষ্কার শব্দে ডায়েরীতে লিখেছে----

বিষয়ঃ ফানুস

১। রাত্রিকালীন অনুষ্ঠানের প্রথম পদক্ষেপ ফানুস উড্ডয়ন। পুরান ঢাকার ফানুস যথেষ্ট ভালো। আগাসাদেক লেনে পরিচিত ফানুসের দোকান আছে। দোকানের নাম স্মরণ নেই। বিয়ের কেনাকাটার সময় পায়ে হেটে খুঁজতে হবে।

২। একটা মাজারী সাইজের নৌকা লাগবে। নৌকা থাকবে মাঝনদীতে। সেখান থেকেই ফানুস উড়বে। নৌকায় মাঝি থাকবে না। মাঝির বৈঠা থাকবে আতাহারের হাতে। নৌকাডূবি সংক্রান্ত বিপদ মোকাবেলা করবে মাঝি। তীরে সে আরেকটি পটল সাইজের রেসকিউ নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করবে।

৩। ফানুস উড়বে কৃষ্ণপক্ষে। হিন্দু পঞ্জিকা দেখে তারিখ বের করা হবে। পুর্ণিমায় করা যাবে না। পুর্নিমা ফানুসের আলো গ্রাস করবে। সেই সুত্রে বিবাহও হবে অমাবস্যায়। গাঢ়অন্ধকারে লাল ফানুস জ্বলজ্বল করে উড়ে যাবে।

বিয়ে বাড়ির ভেতরে মানুষজন বেশ মাতামাতি করছে। মন্টুর দোকান থেকে তাদের মাতামাতির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মফঃস্বলের বিয়ে। এসব বিয়েতে বোমাবাজির মত পটকা ফাটানো হয়। কিছুক্ষণ আগে একদল ছেলে এসে আতাহারের কাছে দেয়াশলাই ধার করেছে। যেহেতু সিগারেট নেই তাই দিয়াশলাইয়ের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। কিছু প্রয়োজন পারস্পারিক। একজনের অনুপস্থিতিতে আরেকজন মূল্যহীন। আতাহার আজ দেয়াশলাই। নীতু হল সিগারেট।
পটকা সমানে ফাঁটছে।
আতাহারের বর্তমান চিন্তা ব্লু বার্ডের চাকা থেকে বিচ্যুত হয়ে পটকার সংখ্যায় কেন্দ্রীভূত। পটকার শব্দ শুনে গুনে ফেলেছে। ইতিমধ্যে ফেটেছে তেরটা। চৌদ্দতম পটকা ফাঁটানো সম্ভব নয়। আতাহারের দিয়াশলায়ে কাঠি ছিল তেরোটা। ছেলেগুলোর জন্য খারাপ লাগছে। আগে জানলে সে নতুন ম্যাচ কিনে আনত।
কিছুক্ষণ আগে বিয়েবাড়িতে কাজী প্রবেশ করেছে। কাজি প্রবেশ করার কতক্ষনের মাঝে বিয়ে পড়াতে পারবে? এক ঘন্টা? দেড় ঘন্টা? আতাহার ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল। তার হাতে ঘড়ি নেই। সাধারণত চায়ের দোকানে ঘড়ি থাকে না। এই দোকানে আছে। ঘড়িতে বাজে দশটা তেরো। কাজী কতক্ষণ আগে ঢুকেছে? দশ মিনিট? পনের মিনিট? বিয়ে পড়াতে এখনো পৌনে এক ঘন্টা দেরি। এই দীর্ঘসময় বর-কনে কী করছে?
আতাহার চিন্তাকে বর-কনেতে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করল। পারল না। নীতু অপেক্ষার মুহুর্তে বই পুড়ত। শেষবার তার হাতে ছিল- যদ্যপি আমার গুরু। আতাহার আসতে দেরি করল এক ঘন্টা। এই এক ঘন্টার অপেক্ষার মুহুর্তে নীতু অর্ধেক পাতা পড়ে ফেলল। নীতুর বেশকিছু ভাল স্বভাবের একটি হল, বইয়ের চমৎকার কোন বাক্য অথবা তথ্য মুখস্ত করে ফেলা। এই বইয়ের মুখস্ত অংশটুকু হল,
‘যদ্যপি আমার গুরু, শুড়ি বাড়ি যায়
তথাপি তাহার নাম, নিত্যানন্দ রায়।

দ্বিতীয়বার বৃষ্টি নামল।
আকাশ পরিষ্কার ছিল। কেউ প্রস্তুত ছিল না। দোতলা ছাদে ছামিয়ানা টাঙানো। বর কনের জন্য আলাদা বসার আসন। সব ভিজে গেল। লোকজন নিচে নেমে গেছে। বিবাহের বাকী কার্যাবলী ঘরেই সম্পন্ন হতে পারে। বৃষ্টির মাঝেও বেশ হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। মোহরানা নিয়ে ঝামেলা বাঁধতে পারে। মফঃস্বলে বিবাহের অবশ্য পালনীয় কর্মাকাণ্ডের মধ্যে একটি হল দ্বিপাক্ষিক মোহরানা নির্ধারণ জটিলতা।
নীতুর সাথে আতাহারের মোহরানা বিষয়ক ব্যাপারটির নিষ্পত্তি হয়েছে বিবাহের বহু পূর্বেই। নীতুর চাহিদা অল্প। আর্থিক মোহরানার পরিবর্তে বিবাহের প্রথম তিন বছর তাকে তিনটি নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করতে হবে। অভিজ্ঞতা তিনটি সে নিজহাতে কাগজে তালিকাবদ্ধ করে করে দিয়েছে। ঝকঝকে সাদা পাতায় নীতু লিখেছে,

বিষয়ঃ মোহরানা

১। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে হাতির পীঠে চড়াতে হবে। অপরিষ্কার হাতি হলে চলবে না। অধিকাংশ মাহুত হাতিকে গোসল করায় না। পৃষ্ঠারোহন পর্বের পুর্বে হাতিকে সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করাতে হবে। সাবানের ব্র্যাণ্ড আলোচনা সাপেক্ষ।

২। দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে একান্ন প্রজাতির একান্নটি ফুলগাছ এনে দিতে হবে। সংখ্যাটি কেন একান্ন, এবিষয়ে কোন প্রশ্ন নিষিদ্ধ।
টবে ফুলগাছ অধিকতর গ্রহনযোগ্য। তালিকায় গোল্ডেন শাওয়ার এবং গাজানিয়া বাধ্যতামূলক। গাজানিয়ার পোলিশ গোত্র আনলে পত্রপাঠ বিবাহবিচ্ছেদ।

৩। এটি গুপ্ত অভিজ্ঞতা। প্রথমও দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা পূরণের পর তৃতীয়টি উন্মুক্ত হবে।

তৃতীয় অভিজ্ঞতা কী হতে পারে, আতাহারের জানতে ইচ্ছা করেছিল।
মহাকাল তার গর্ভে অধিকাংশ ইচ্ছাকে সুপ্ত রাখে। উন্মুক্ত ইচ্ছাকে রাখে অপূর্ণ। এটিও সেই গোত্রের। লাউ কুটতে খরতর অবস্থা করেও নীতুর তৃতীয় গুপ্ত অভিজ্ঞতার কথা জানা গেল না। অভিজ্ঞতা-তালিকা প্রদানের চতুর্থদিন নীতু টেলিফোন করল।
‘তুমি কোথায়?’
‘হাসপাতালে।’
‘আশ্চর্য! হাসপাতালে কেন?’
‘ঘুরতে এসেছি।’
‘অবাস্তব কথাবার্তা বলবে না। যন্ত্রণা। এক্ষুনি চলে আসো। জরুরী কথা আছে। কোথায় আসতে হবে মনে আছে?’
‘মনে আছে।’
‘গুড।’
নীতু বড় অদ্ভুত সময়ে আতাহারকে আহ্বান করল।
নীতু আহ্বান বরাবরই দূর্বোদ্ধ। দূর্বোধ্যতার মাত্রা পরিমাপের মাপকাঠি আতাহার তার প্রেমজীবনের প্রথম লগ্ন থেকেই খুজে ফিরছে। এখনো তা অধরা।
নীতুর ভাবগতিক সুবিধার মনে হল না। আতাহারকে স্বতন্ত্র বাক্য বলার তেমন সুযোগ দেওয়া হল না। তার অধিকাংশ বাক্যের দৌড় হল ‘ওহ’ নামক নির্ভেজাল ক্ষুদ্রতম বাক্য পর্যন্ত। নীতু প্রায় নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘আমার বিয়ে। বাবা আমাকে না বলে ঠিক করেছেন।’
আতাহার বলল, ‘ওহ।’
‘ওহ কোন কথা নয়। সোজা কথা বল।’
‘সোজা কথা কী শুনতে চাও?’
নীতু নির্লিপ্ত গলায় বলল,
‘আমি কিছু শুনতে চাই না। বিয়ে হবে। শ্রাবণের সাত তারিখ বিয়ে।’
‘ওহ।’
‘আমি চাই বিয়েতে তুমি আসো। খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যাপারটাকে গ্রহণ কর। মইন খুব ভাল ছেলে।’
‘মইন কে? যার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে?’
‘হ্যা। সে তোমার কথা জানে।’
‘পাঁচ বছর প্রেম করেছি, এটাও জানে?’
‘হ্যা জানে।’
‘ব্যাপারটা কীভাবে গ্রহণ করেছে?’
নীতু ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘সে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। আমি চাই, তুমি তার সাথে কথা বলবে। হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করবে। এরপর বলবে- হ্যালো। বলতে পারবে না?’
‘পারব। আর কী করতে হবে?’
‘আর কিছু করতে হবে না। কবে বিয়ে মনে আছে?’
‘আছে। শ্রাবণের সাত তারিখ।’
‘কোথায় বিয়ে মনে আছে?’
‘কোথায় হবে এখনো বলোনি। বললেই মনে থাকবে।’
‘গুড। বিয়ে হবে বাড়িতে। সোজা চলে আসবে।’
‘আসব।’
নীতু আর কোন কথা বলল না। আতাহার শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
‘তোমার বিয়ে হলে আমার খারাপ লাগতে পারে। আমি মইনের মত স্বাভাবিকভাবে ব্যাপারটা হয়তো নিতে পারব না। তুমি কী কোন বিশেষ কথা আমাকে বলতে চাও?’
নিতু বিরক্ত গলায় বলল,
‘কী বিশেষ কথা শুনতে চাও?’
‘আমার কোন পছন্দ নেই। তুমি যা ইচ্ছা বলতে পারো।’
নীতু বলল,
‘The bad news is nothing lasts forever. The good news is nothing lasts forever.কার কথা জানো?’
‘না জানি না।’
‘সিডনি শেলডনের কথা। Nothing Lasts Forever বইতে আছে।পড়ে নিও।’
‘হুম।’
‘হুম কী? তুমি কিছু বলতে চাও?’
‘হুম।’
‘বলে ফেল। জড় কাঠের মত নিশ্চল মানুষ আমার পছন্দ না। দ্রুত বল।’
আতাহার বলল,
‘তোমার তৃতীয় অভিজ্ঞতার ব্যাপারটি কী ছিল? আমি এনিয়ে রীতিমত গবেষনা করেছি। কোন কূলকিনারা করতে পারিনি।’
নীতু হতাশবোধ করল। নিরাসক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল,
‘যন্ত্রণা করবে না। আমি যাই।’

আজ শ্রাবণের সাত তারিখ।
আতাহার অনেকবার চেষ্টা করেও বিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারল না। ঢুকতে পারলে সকালের খানার একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত। পঞ্চ কাপ থিউরি প্রয়োগ করতে হত না। সুবিধা হল আতাহারকে বিয়ে বাড়ির কেউ চেনে না। চুপচাপ খেয়ে কেটে পড়া যাবে। অসুবিধার দিকটাও বেশ ভারী। নীতু দেখে ফেলতে পারে। তার বিবাহের দিন প্রাক্তন প্রেমিকের উপস্থিত হওয়া কাজের কথা না। প্রকৃতির মহাপরিকল্পনার অংশ হিসাবে একজন প্রেমিক-পুরুষকে বিভ্রান্তির অথৈ জলে ফেলে আরেকজন সম্পুর্ন অপরিচিত মানুষের সাথে নীতুর বিয়ে হচ্ছে। এক বন্ধন ভাঙ্গছে, আরেকটা গড়ছে। বন্ধন ভাঙ্গা-গড়ার এই মহাপরিকল্পনায় অনর্থক উপদ্রবের মত প্রবেশ করা উচিৎ নয়। প্রকৃতি উপদ্রব পছন্দ করে না। সীমা অতিক্রম করলে ঝড়ে উড়িয়ে দেয়। আতাহার এখন আত্মশ্লাঘায় ভুগছে। সে নিজে উপদ্রব নাকি প্রকৃতির ঝড় এই ব্যাপারে কূলকিনারা করতে পারছে না।
লোকজনের হৈচৈ থেমে গেছে। মোহরানা বিষয়ক জটিলতা কেটে গেছে। অতি সম্ভব কাজি সাহেব বিবাহ পড়াচ্ছেন। গম্ভীর গলায় বলছেন,
‘......বিশ লক্ষ এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া ...নিবাসী ...এর পুত্র মোহাম্মদ মইনের সহিত...... বল মা কবুল।’
আবার হৈচৈ শুরু হল।
বিবাহ পর্যায়ের সম্ভাব্য সমাপ্তি। এখন খানাপিনার সময়। আতাহার অবদমিত ক্ষুধা নিয়ে নিয়ে মন্টুকে তৃতীয় কাপের অর্ডার করল।

বিকেল গড়াল।
আতাহার অনেকবার চেষ্টা করেও মন্টুর চায়ের দোকান থেকে উঠতে পারছে না। তার চিন্তা পুনরায় গাড়ির চাকায় ফিরে গেছে। ড্রাইভার নেমে গেট খুলেছে। বর কনে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নীতুর পাশে দাড়ানো পাঞ্জাবী পরা ছেলেটাই সম্ভবত মইন। আতাহার বিস্মিত হয়ে তাকাল। তার নাতিক্ষুদ্র জীবনে এত চমৎকার ও সুদর্শন ছেলে দেখেছে বলে স্মরণ করতে পারছে না।আত্মবিশ্বাসী ও কঠিন ধরণের ছেলে। নববধুর হাত ধরে যেভাবে সীনা টানটান করে দাঁড়ানো উচিৎ সেভাবেই দাড়িয়েছে। নীতুকে কিছুটা আয়েশী মনে হচ্ছে। এই ছেলে নিশ্চয় জড় কাঠের মত নিশ্চল নয়। তাকে ভরসা করা যায়।
বরের দৃষ্টি আটকে আছে নিশান ব্লু বার্ডের পেছনের চাকায়। সামান্য পানিভর্তি গর্ত থেকে চাকা এতক্ষনে উঠে যাবার কথা কিন্তু উঠছে না। ড্রাইভার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও চাকা উঠাতে পারল না। বিয়ের প্রথম লগ্নেও তাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। আতাহারের মত সামান্য চাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবার মত সময় তার নেই।
নীতুর এক হাত এখনো বরের মুষ্ঠিতে আবদ্ধ। অন্যহাতে নীতু নাক চেপে ধরে আছে। বদ্ধগাড়ির আগাম যাত্রা বমির উদ্রেক ঘটাচ্ছে।আতাহার জানে নীতু এখন কতটা নিরুপায়। বমি করার স্বভাব নীতুর বেশ পুরোনো একবার ভার্সিটির কানাকানায় পুর্ণ বাসে সে বমি করে আতাহারের শার্ট ভিজিয়েছিল। এরপর সুদীর্ঘ প্রেমকালে সে কখনোই বাসে ওঠেনি। অল্প জমিনের রিক্সায় সে আতাহারের পাশাপাশি বসেছে। পুরোনো অতীত। বিরহী প্রেমিকের পুরোনো অতীত একসমুদ্র জলের মত। চৈত্রে নদী শুঁকায়। সমুদ্র শুঁকায় না। একমুদ্র স্মৃতির স্রোত দিনরাত গর্জন করে ডাকাডাকি করে।
ব্লু বার্ডের চাকা এখনো ওঠেনি। মইন কয়েকবার চায়ের দোকানের দিকে বিনীত ভঙ্গীতে তাকিয়েছে। একাদশ মাত্রার বিপদ সংকেত। চায়ের দোকানে আতাহার এবং মন্টু ছাড়া কেউ নেই। মইন যদি বিনীত গলায় বলে, ‘একটু সাহায্য করবেন? চাকা উঠছে না। ঠেলতে হবে’ তখন আতাহার কী করবে? এই ছেলের বিনয় এড়াবার মত ক্ষমতা তার নেই। প্রেমিকার শেষ বিপদে ধাক্কা দিয়ে আরেক কূলে পার করে দেবার মত মানসিক শক্তিটুকু তার অবশিষ্ট নেই। নীতু ও মইন নামক ছেলেটির চোখের আড়ালে বাতিল উপগ্রহের মত হারিয়ে যেতে হবে। খুজে নিতে হবে আলাদা কক্ষপথ ও আলাদা আবর্তনকাল। মহাজাগতিক দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় হয়তো আতাহারকে মাঝেমাঝে খুব কাছ দিয়ে চলে যেতেও হতে পারে। সেই চলে যাওয়া হবে নীরব। নীতুর টেলিস্কোপের ভিজুয়াল ফিল্ডের বাইরে দিয়ে। আতাহার পঞ্চম কাপ চা না খেয়েই মন্টুর দোকান থেকে বিদায় নিল।

হাসপাতালে কেবিনের দরজায় আতাহারকে আটকে দেওয়া হল।
মায়ের পেটে ব্যাথা উঠেছে। এখন নিশ্চয় সে বালিশ চাপচাপি করে কান্নাকাটি করছে। আতাহারের একবার মনে হল সে ভুল সময়ে চলে এসেছে। তার নাতিদীর্ঘ জীবনের একটি বিরাট অংশ কেটে গেছে ভুল সময়ের চক্রে পড়া। এই চক্র থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ ব্যাপারটিকে সহজভাবে গ্রহণ করা। নির্লিপ্তভাবে এড়িয়ে যাওয়া। আতাহার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কী করবে। স্বচ্ছ গ্লাসের ভেতর দিয়ে দুজন ডাক্তারের মাথা দেখা যাচ্ছে। পাশে একজন নার্স। নার্সের দৈর্ঘ্য খাটো হওয়ায় শুধু মাথার ব্যাণ্ড দেখা যাচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। ডাক্তার দুজনের একজন বেশ গম্ভীর হয়ে পাশের ডাক্তারকে নির্দেশনা দিচ্ছে। পাশের ডাক্তার মাথা নীচু করল। তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। রোগীর শরীরে হাত দিয়ে জটিল শারিরীক পরীক্ষাগুলো করার জন্য তিনি অবনত ভঙিমায় চলে গেছেন।
ডাক্তারের পাশে উঁচু শেলফ। শেলফে ঔষুধ। কয়েকটা ফলের পোটলা। পোটলার পাশে লাল রঙের একটা প্যাকেট। সিগারেটের প্যাকেট এখানে কীভাবে আসল সে বুঝতে পারল না।
এই মুহুর্তে আতাহারের কোন কাজ নেই। দুজন ডাক্তার কেবিনের ভেতর। নার্স পেইনকিলার দিচ্ছে। সে হাসপাতাল থেকে বের হল। একটা ছোট টঙের দোকান থেকে গোল্ডলিফ কিনে ধরাল। সাঁঝবেলাতে দিনের প্রথম সিগারেট। মাথা অল্প চক্কর দিল। চক্কর দেওয়া মস্তিষ্কে আতাহার রাস্তার মাঝখান ধরে হাটতে শুরু করল। তৃতীয়বার বৃষ্টি নেমেছে। আগের চেয়ে কিছুটা জোরালো বৃষ্টি। বৃষ্টির নিচে সে হাতের ফাকে বেশ কায়দা করে সিগারেট লুকিয়ে ফেলল। প্রথম সিগারেট নষ্ট করা যাবে না। পকেটে টাকা নেই। মায়ের কাছ পর্যন্ত না পৌছাতে পারলে পকেটপূর্ণ হবার সম্ভাবনাও নেই। অর্থশূন্য অবস্থাতে অবশ্য ততটা খারাপ লাগছে না, যতটা খারাপ লেগেছিল সিগারেট শূন্য অবস্থায়। সিগারেট হাতে আতাহার ধীর কদমে পথ চলছে। ঝড় বৃষ্টিতে রাস্তায় গাড়ি নেই। শূন্য শহুরে রাস্তায় আতাহারের এখন নিজেকে কানা গরুর মত মনে হচ্ছে। কানা গরুর নির্দিষ্ট চলার পথ থাকে না। অথবা কানা গরু ভিন্ন পথে চলে। এপথ শুধু তার একার। সেখানে রাখাল থাকে না, মালিক থাকে না।
___________________________

ডা. রাজীব হোসাইন সরকার । কথাশিল্পী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়