Ameen Qudir

Published:
2018-06-24 14:49:26 BdST

জামাইষষ্ঠী :' আমার শাশুড়ি মা-ও সবকিছু বুঝে আমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন'


 



দেবব্রত তরফদার
____________________________
মা ষষ্ঠীর কৃপায় সন্তানলাভ তাই ষষ্ঠী ঠাকরোণকে তুষ্ট করার জন্য বার বার তার অর্চনা । দুর্গাষষ্ঠী , অশোকষষ্ঠী , মুলোষষ্ঠী , শীতলা ষষ্ঠী , চাপড়াষষ্ঠী এবং জামাইষষ্ঠী । আরো অনেক ষষ্ঠী থাকতে পারে তার জন্য অবশ্য পঞ্জিকার সাহায্য নিতে হবে। গ্রামে এর ধুমধাম ছিল খুব। প্রতিটা গ্রামেই একটি করা ষষ্ঠী গাছ থাকে । বট অশ্বত্থ পাকুড় এই সব বড় গাছ হিন্দুদের কাছে পবিত্র তাই এই সব গাছকে ষষ্ঠী গাছ হিসেবে ধরা হয়। আমাদের গ্রামের ষষ্ঠী গাছটি ছিল নদীর ধারে খেয়া ঘাটের কাছে। জামাইষষ্ঠীর দিন এখানে মেলা বসে যেতো। এদিন এয়ো স্ত্রীরা তাদের পুজোর উপাচার নিয়ে গাছতলায় হাজির হতো । পুজোর উপাচারে থাকতো তেল হলুদ সুতো খেজুর ছড়া করমচা গন্ধরাজ লেবু কচি বাঁশপাতা আম কলা আর অন্যান্য ফল। নতুন তালপাতার পাখার উপর এগুলো রেখে স্নান করানো হয় তারপর সেই জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় সন্তান এবং জামাই বাবাজীবনদের মাথায় । সন্তানদের কপালে দেওয়া মন্ত্রপূত তেলহলুদের ফোটা আর সাদা সুতো হলুদে ছুপিয়ে হাতে বেঁধে দেওয়া হত। ষষ্ঠীগাছও বাদ পড়তো না প্রাপ্য থেকে তাদের গায়ে দুধ ঢালা হতো আর পাকাকলা খোসা ছাড়িয়ে তাদের গায়ে চিপকে দেওয়া হয়। জামাই বাবাজীবনদের শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে ষষ্ঠীতলায় যেতে হতো , বিশেষ করে নতুন জামাইদের । গ্রামতুতো শালাশালীরা ঠাট্টা ইয়ার্কির সুযোগ পেয়ে যেত আবার হোলির মত তেলহলুদ মাখামাখিও চলত।

ষষ্ঠীর সময় বর্ষাও নেমে যেত । আম কাঁঠালের সঙ্গে হাঁটুভর কাদা গোবর নীল ডুমো ডুমো মাছি একদম ভরপুর প্যাকেজ। নতুন জামাইবাবাজীবন রা আগের দিনই চলে আসতো । আমাদের চারদিকে ছিল জেলেদের বাস , অধিকাংশই মাছমারা , গরিব লোকজন। ছোট বাচ্চারা একটা প্যান্ট বা ইজের পরেই থাকতো খালি গা খুব ছোটগুলোর আবার কিছুই থাকত না। নতুন জামাইবাবুর জন্য তাদের থাকতো অপেক্ষা ।আর জামাইবাবুকে আসতে দেখা গেলে তাদের উচ্ছাস । কালো কালো আধন্যাংটো বাচ্চাগুলোর সঙ্গে ধোপদুরস্ত জামাই বাবুকে খুবই বেমানান লাগতো। পুরোনো জামাইরা অনেকেই আসতো দিনের দিন। চাষের কাজকর্ম সেরে অনেকেরই বিকেল গড়িয়ে যেত। বউ এর কাঁখে একটা পোটলা , জামাই বাবাজীবনের হাতে মিষ্টির হাঁড়ি , কাঁধে কাঁঠাল আর রাস্তায় কাদা থাকলে জুতো হাতে বা মাথায় । কাদার মধ্যে ঘপরঘপর করতে করতে চললেন। এমন দৃশ্য দেখা যেত হামেশায়। পাড়াতুতো শ্যালকদের শ্যেনচক্ষু থাকতো হাঁড়ির দিকে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো বুড়ো জামাইদের আগমন। জামাইদের নিমন্ত্রণ করাকে গ্রামের ভাষায় বলা হতো জামাই নেওয়া। তাই নিজের শাশুড়ি ছাড়াও কাকী মামী মাসি বা পিসি শাশুড়িরা ও জামাই নিতেন।

জামাইষষ্ঠীর দিন ছিল অৱন্ধন । দুপুরে চিড়ে মুড়কি দই গুড় মিষ্টির ফলার। আমাদের দিদিরা ছিল ছোট তাই জামাই বাবাজি দের আগমন ঘটেনি কিন্তু একদিনের চিড়ে দই এর ফলার ভালোই লাগতো। সেদিন রাতে লুচি খাবার মজাও ছিল।পনেরো বিশ দিন আগে থেকেই ভোরে চিড়ে কোটার জন্য ঢেকির পাড় পড়তো। খই ভাজা আর মুড়কি বানানোর গরম গুড়ের সুগন্ধ ভেসে আসতো। গোয়ালারা বড় বড় মাটির হাঁড়িতে দই পাততো । পরদিন মাছ মাংস খাওয়া হত।

বিয়ের পর জামাই হলাম , গ্রামেরই বলা যায়। শাশুড়ি মা ষষ্ঠীতলায় যাওয়া থেকে নিস্তার দিয়েছেন। এখন গ্রামেও দই চিড়ের রেওয়াজ নেই । আমার শশুর মহাশয়ের বদরাগী হিসেবে খ্যাতি ছিল। চেহারাটিও তেমনই দশাসই । জামাই এর চেহারাটি সেই তুলনায় নেহাতই বেমানান । কিন্তু জামাই বাবাজি দুর্ধর্ষ শশুর মসাইটিকে প্রথম থেকেই কব্জা করে ফেলেছিল। নিজের ছেলেদের চাইতেও জামাইয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং নির্ভরতা ছিল বেশী। সাদা শার্ট ই পড়তেন। কিন্তু বেয়াড়া এবং নাছোড়বান্দা জামাই কালারফুল টি শার্ট জোর করে পরানোতে জনসমক্ষে লজ্জিত হতেন । আবার মুখে শিশুর মত হাসি ফুটত। আমার শাশুড়ি মাও ব্যাপারটি উপভোগ করতেন। জামাই বাবাজীবন ভোজনরসিক হলেও শশুরের মত নয়। তবে জামাইয়ের পছন্দের গঙ্গার মাছ , নধর খাসির মাংস স্পেশাল দই বিখ্যাত ছানার জিলিপি এসব নিজে হাতেই কিনতেন। নিজে খেতে খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন । হার্টের অসুখে ভুগতেন , অনেকবার কল্যাণী হাসপাতালে রাতবিরেতে ছুটতে হয়েছে। কিছু হলেই বলতেন দেবুকে খবর দাও । দেবু যেন মুস্কিল আসান। শেষে খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।ছেলেমেয়েরা পাহারায় থাকতো। অনুষ্ঠান বাড়িতে যাওয়ার বিধিনিষেধ ছিল। একবার দুর্গা নবমীতে গিয়ে দেখলাম আমার জন্য মাছ মাংস সবই কেনা হয়েছে। খেতে বসে দেখলাম ওনাকে দেওয়া হয়েছে ট্যালটেলে চিকেনের ঝোল। উনি করুন হেসে বললেন ,এই দিয়ে কি খাওয়া যায়।বলে ডাল দিয়ে খেয়ে উঠে গেলেন। তারপর কি আমার গলা দিয়ে ভাত নামে। আমার স্ত্রীকে বার বার বলা সত্বেও রাজি হল না । পরদিনই সব শেষ। আজ সকালে উঠে ওনার সেই করুন মুখটা মনে পড়ে গেল।

এটা বারোবছর আগের কথা । এর মধ্যেও দু একবার গেছি কিন্তু তাল একদম কেটে গেছে। যত্নের কোন ত্রুটি হয়না কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই তাঁর ছায়া দেখি। তার কন্ঠস্বর কানে বাজে। তাই ক্ষান্ত দিয়েছি। আমার শাশুড়ি মা ও সবকিছু বুঝে আমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন।
_________________________

দেবব্রত তরফদার। দরদী কথাশিল্পী। তাঁর লেখারজীবন ছবি লাখো পাঠককে মুগ্ধ করছে।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়