Ameen Qudir

Published:
2018-06-19 16:19:25 BdST

আনন্দময় সেকালের ইদ এবং একালের নিরানন্দ ইদ


 


ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
___________________________

আমার ঈদের দিনের স্মৃতি শুরু হতো ঘুম ভেঙে চোখ খুলে আম্মুকে খোজার মধ্যে দিয়ে।বাইরে কালিগোলা অন্ধকার,অথচ আম্মু নাই।আম্মু কই?আম্মু ততক্ষণে নিচে নেমে অন্যান্য চাচী ফুপুদের সাথে কাজ করতে বসে গেছেন।আমি আরো কিছুক্ষণ ঘুমের মাঝেই কিংবা আধো জাগরণে "আমার আম্মু কই" বলে খোঁজাখুঁজি করে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম।

ঘুম ভেঙে দেখতাম বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে আত্মীয়-স্বজন দিয়ে।কেউ দুদিন আগে এসেছেন,কেউবা সপ্তাহ।এর মাঝেই গোসল টোসল সেরে আম্মু কিংবা আব্বু খুব তাড়াহুড়ায় আমাদের তৈরি করে দিতেন নামাজের জন্য।আমরা ঘুম ঘুম চোখে পায়জামা পাঞ্জাবী পড়ে বড়দের জন্য অপেক্ষা করতাম।নামাজ পড়ার জন্য বড়দের হাত ধরে বের হয়ে দেখতাম রাস্তায় মুসল্লিদের সারি।সবাই পায়জামা পাঞ্জাবী আর মাথায় টুপি দিয়ে চলছে মসজিদ কিংবা ঈদগাহের দিকে।অবাক চোখে এইসব দেখতে দেখতে মসজিদে চলে যেতাম।নামাজ শেষ করে আব্বু আর চাচারা আমাদের ছোটদের হাত ধরে বিভিন্ন আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি নিয়ে যেতেন।প্রতিটা বাড়িতেই কিছু না কিছু মুখে দিতেই হতো,খালি মুখে ফেরত আসাটা তারা কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতেন না।এভাবে আত্মীয় বাড়ি ঘুরেফিরে নিজেদের বাড়ি যখন ফেরত আসি,তখন সকাল অনেকখানি গড়িয়ে গেছে,সাথে পেটও ভরে টইটুম্বুর প্রায়।

এসেই দেখতাম,বাড়ি আমাদের লোকে লোকারণ্য,খাওয়াদাওয়া শুরু হয়ে গেছে পুরোদ্যমে।আমার দাদা এলাকার সম্মানিত এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন,আমাদের বাড়ির রেওয়াজ ছিলো আমাদের সমাজের সব লোকেদের মেহমানদারি করা।এলাকার প্রায় সবাই আসতেন সেই খোলা নিমন্ত্রণে।খাবারের আয়োজন থাকতো ব্যাপক।খিচুড়ি,বিভিন্ন পদের ভর্তা,নানা রকম পিঠা,সাথে মাছ মাংস তো ছিলোই।আর সবার শেষে মিষ্টান্ন।মিষ্টান্ন চেনেন?ঘরে বানানো ফিরনি,পায়েস,দই এইগুলোকে একসাথে বলে মিষ্টান্ন।
যা ই হোক,আমরাও বসে পারতাম এক ফাকে।ফুপু চাচিরা ইয়া বড় বড় গামলা ভর্তি করে খিচুড়ি আর ধামা ভর্তি করে নিয়ে আসতেন পিঠা।মুহূর্তেই শেষ হয়ে যেত সব,আর ছোটদের দৌড়ে পাঠানো হতো রসুইঘরে আরো খানিকটা নিয়ে আসার জন্য।খানিকবাদেই চলে আসতো ধামা ভর্তি পিঠা কিংবা খিচুড়ি।
আমার বাপ চাচারা আর বড় ভাইয়েরা এই খেদমতগারি করতেন।সবার কাছে যেয়ে প্লেটে প্লেটে তুলে দিতেন ফুরোবার আগেই।এখনকার মতো এতো ভদ্রতার চল ছিলো না তখন।কেউ খাওয়া শেষ করে ফেলার পরেও যদি এক বাটি মিষ্টান্ন ঢেলে দেয়া হতো তার পাতে,তিনি রাগ করে হাত পা ছুড়োছুড়ি করতেন না,হাসিমুখে কিছুক্ষণ খাবারের দিকে তাকিয়ে পেটে চালান করে দিতেন।সেই সময় প্লেটের পর প্লেট খেতে পারা একটা বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

এই খাওয়াদাওয়ার পুরো দায়িত্বে থাকতেন আমার দাদি।তিনি তার মেয়ে আর ছেলের বৌদের নিয়ে ভোর রাত থেকে এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ঝাপিয়ে পড়তেন।এতো মানুষের খাওয়া,যেনতেন কথা ছিলো না কিন্তু।তার উপর সব মেহমানদের যত্নের প্রতি ছিলো তার কড়া নজর।আর দাদা হয়তো বাইরে উঠোনে বসে থাকতেন কিংবা ঘরে,মেহমানেরা খাওয়া শেষ করে সবাই দাদার সাথে যেয়ে দেখা করে আসতেন,সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ থাকলে সেটাও সেরে নিতেন।

আর আমরা ছোটরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে নতুন জামা পড়ে বেরিয়ে পড়তাম।বেরোবার আগে দাদা দাদী বাবা মা চাচা চাচী ফুপু ফুপা সহ যতো বড় মানুষ চোখের সামনে পড়তো,তাদেরই পায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিতাম।সালামী।অধিকাংশই দশ কিংবা বিশ টাকার নোট দিয়ে বিদায় করতো,কিন্তু কেউ কেউ আবার একশ টাকার একটা কিংবা কয়েকটা নোট ধরিয়ে দিতো।এমন পেলে আমাদের খুশি আর দেখে কে।সব ভাই বোনেরা মিলে বেরিয়ে পড়তাম বাইরে।
মেলা হতো তখন প্রতি ঈদের দিন,ঈদ মেলা।আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতাম,পকেটে তখন সদ্য পাওয়া সালামীর টাকা,কিছু পছন্দ হলেই ঝটপট পকেটস্থ করতাম।মেলা ঘোরা শেষ করে বের হতাম ঘুরতে।রিক্সা নিয়ে,ঘন্টা চুক্তিতে।এক ঘন্টা কতো ছিলো?বিশ কি ত্রিশ টাকা,খেয়াল নেই আসলে।এই সব ঘুরাঘুরি শেষ করে যখন ঘরে ফিরতাম,তখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেছে।

দুপুরের পর,খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুরু হতো অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব-বাংলা সিনেমা।আমরা টিভি খুলে অপেক্ষা করতাম,আর দোয়া করতাম যেন ইলেক্ট্রিসিটি না চলে যায়।তখন লোড শেডিং হতো ভয়াবহ,এক ঘন্টা থাকে তো দুই ঘন্টা নাই।এর মাঝেও আমরা পুরো সিনেমার আনন্দ উশুল করতাম।আর ছিলো বিজ্ঞাপন বিরতি।উফ আল্লাহ,মিনিমাম পঞ্চাশ ষাটটা বিজ্ঞাপন হতো।আমরা আর কি করবো,বসে বসে বিজ্ঞাপন গুনতাম।

আমাদের বাড়ির মাঝখানে ছিলো ছোটখাটো একটা উঠান।সন্ধ্যা নামার আগেই চারপাশের বাড়ির আলোয় রোশনাই হয়ে উঠতো সেই উঠান।আর সন্ধ্যায় হতো আড্ডা আর খেলাধুলা শুরু হতো সেই উঠান জুড়ে।ছোটখাটো ঘরোয়া খেলা,উঠানে যা খেলা যায় আর কি।হৈ চৈ করতে করতে একসময় খেলা শেষ হতো,কিংবা করতে হতো।ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়েছে।রাতের খাবারের তাড়া পড়ে যেতো অন্দরমহল থেকে।সেই খাওয়াদাওয়া শেষ করে অপেক্ষা শুরু হতো আরেক আকর্ষণের-"আনন্দ মেলা"।বিটিভিতে শুরু হতো রাত দশটার ইংরেজি সংবাদের পর।বিজ্ঞাপনের মাঝে আনন্দ মেলা হতো না আনন্দ মেলার মাঝে বিজ্ঞাপন-কে জানে।সেই আনন্দ মেলা দেখতে দেখতে আমরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম,বুঝতেই পারতাম না।

মাঝে মাঝে আমি সেইসব দিনের কথা ভাবি,ঈদের দিনগুলোতে আরো বেশি মনে পড়ে যায়।বর্তমান সময়ের নিরানন্দ ঈদের দিনের সাথে আর দশটা দিনের পার্থক্য খুঁজে পাই না তেমন।ভয় হয়,আমার স্মৃতিতে তো তবু কিছু আনন্দের উৎস রয়ে গেছে,আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কি তেমন কিছুর ছিটেফোঁটা রেখে যেতে পারবো আমরা?
____________________________


ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ
০২ ব্যাচ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়