Ameen Qudir

Published:
2018-05-21 16:18:38 BdST

রোজানামচা"রোজার মাস এবং একটি বোর্ডিং স্কুল"



বই মেলায় সুহৃদ পাঠকদের সঙ্গে লেখকের ছবি।


ডা. নাসিমুন নাহার মিম্ মি
_________________________________

(প্রথম পর্ব)

পাপবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছি। মরে যাই যাই টাইপ ভীষন রকম ফ্রাসট্রেশনে আর ডিপ্রেশনে ভুগছি।
মনটা অদ্ভুত ভাবে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে যেন। আজ তিনদিন হলো কিছু লিখতে পারছি না।
একটা লাইনও না ! অথচ লেখালেখি হচ্ছে বর্তমানে আমার একমাত্র বন্ধু। গত তিন বছরে যা যা আমার বলতে ইচ্ছে করে লিখেই বলে ফেলছি। এমনকি জীবনের স্বপ্নগুলোও লিখে লিখেই ছুঁয়ে দেখার পাগলামি করছি। কি যে আনন্দ এতে..... হেরে যাবার অথবা না পাবার বেদনা নেই এই বিচিত্র লেখালেখি খেলাতে।

আমি ফেসবুকটা ব্যবহারই করি লেখালেখির প্লাটফর্ম হিসেবে। না না নাক সিটকাবেন না প্লিজ। আপনাদের মধ্যে অনেকেই ফেবু ব্যবহার করেন ছবি আপলোড করতে , কেউবা মোটিভেশন দিতে, শোঅফ করতে,
অনেকেই প্রেম করার জন্য, প্রডাক্ট প্রমোট করতে , যোগাযোগ রক্ষা করতে । কত শত ব্যবহার যে ফেবুর।
আমি নাহয় লেখালেখিই করলাম।

কেন একটা লাইনও লিখতে পারছি না খুঁজতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম ঘটনাটা-----

কর্মসূত্রে আমি এখন আছি বাংলাদেশের প্রথম International Baccalaureate সিস্টেমের বোর্ডিং স্কুলের ক্যাম্পাসে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে। বাংলাদেশে হলেও এর কার্যকারিতা আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত। তাই আমার কাছে সব কিছুই নতুন এখানকার।
এবারের রোজাই এখানে আমার প্রথম রমজান মাস।
আমি নিজেও জানতাম না এমন মন কেমন করা একটা ফেইজের ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হবে কখনো।

Image may contain: 9 people, people smiling, people standing


বই মেলায় সুহৃদ পাঠকদের সঙ্গে লেখকের ছবি।

 

প্রথম সেহেরীতে রাত ঠিক পৌনে তিনটিতে উঠে পড়লাম এলার্ম বাজার সাথে সাথে । সেহেরীতে ডাইনিং এ ডিউটি আছে আমার রাত তিনটা থেকে। আমাদের এখানে পুরো ক্যাম্পাসের সব স্টুডেন্ট, ফ্যাকাল্টি মেম্বার, স্টাফ সবাই একসাথে ইফতার আর সেহেরির করে ডর্ম ওয়ানের বিশাল ডাইনিং এ। এটাই এখনকার নিয়ম। প্রথম দিন(রাত) বলে দারুন এক্সসাইটেড হয়ে আহুকে তুলে পাঞ্জাবী পড়িয়ে মা ছেলে কোয়ার্টার থেকে ছুটলাম ডাইনিং হলে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সাথে পেয়ে গেলাম আরো কলিগদের এবং তাদের পরিবারকে।

গার্লস ডর্মের সামনে এসে দেখলাম আমাদের মেয়ে বাচ্চারা সব নেমে এসেছে ডর্ম সুপার ম্যামের সাথে মাথায় ওড়না স্কার্ফ জড়িয়ে। সব বাচ্চাগুলোকে একদম পরী বাচ্চা লাগছিল। ঠিক তিনটাতে ডাইনিং হলে এলার্ম বেজে উঠলে সবাই সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গেলাম আমরা খাবার নেবার জন্য। আমাদের এখানে ব্যুফে স্টাইলে মিল সার্ভ হয়। তুমি প্রিন্সিপাল হও কিংবা ডাক্তার নো ইস্যু যদি স্টুডেন্ট আমার আগে এসে লাইনে দাঁড়ায় ও আগে পাবে ডিস। আমার কাছে খুব দারুন লাগে এখানকার এই বিভাজনহীন নিয়মকানুনগুলো। তো খাবার নিয়ে সবাই বসে গেছে যার যার টেবিলে।

সাধারণত অফিস ডে গুলোতে আমি আমার ছেলের সাথে এক টেবিলে খেতে বসি না। কলিগদের সাথে বসি। তবে আজ প্রথম সেহেরী ছিল বলে বাচ্চাটার সাথেই বসলাম।আমাদের এখানে চেয়ার টেবিলগুলো ফিক্সড সেটাপের। এক একটা টেবিলে চারজন করে বসতে পারে। আমি আর আহু বসার পর আমাদের সামনের চেয়ারে এসে বসল অর্ক আর ইভান(ছদ্মনাম)। এরা দুজন আমাদের এখানকার সব থেকে জুনিয়র বোর্ডার। বাচ্চা দুটো আমার আহুর থেকেও ছোট।
খেতে শুরু করার পরে হঠাৎ কেন যেন অন্য টেবিলগুলোর দিকে একটু তাকালাম। আর সাথে সাথে ছ্যাঁত করে উঠলো আমার বুকের ভেতরটা। অসংখ্য দেবশিশু বসে সেহেরী করছে একসাথে। আমার পাশেই আমার আহ্ নাফসহ অর্ক ইভান। হঠাৎ করে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার। নিজের ছেলেবেলাতে ওদের এই বয়সে আমার কাটানো রোজার সময়ের সেহেরির কথা মনে পড়ে গেল।আব্বু আম্মু বোনেরা সবাই মিলে একসাথে বসে শেষ রাতে সেহেরির সেই সব অপার্থিব সময়গুলো ফ্ল্যাশব্যাক হতে লাগলো মানসপটে।

আমার কর্মস্হলের বাচ্চাগুলোর জীবন এক একটা উপন্যাস ........ ওরা আমাদের সমাজের উঁচু তলার পরিবার থেকে আসা। শিক্ষা, অর্থ কোন কিছুর অভাব নেই এদের পরিবারের। গত সাত মাসে যতটুকু বুঝেছি অধিকাংশেরই বাবা মা শুধু সময়ের অভাবে সন্তানকে বোর্ডিং এ পাঠানো। কে দেখবে বাসাতে ? নিরাপত্তাসহ বাবা মায়ের দাম্পত্য জীবনের আরো কিছু জটিল সমীকরণের হিসেব মেলাতেই বাচ্চাগুলোর এই অত্যন্ত দামী এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়াস পিতা মাতার।

আমার সৃষ্টিকর্তা কে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি।
না এজন্য না যে তিনি আমাকে সব সময় তার ব্লেসিং দিচ্ছেন বলেন। বরং এজন্য যে তিনি আমার জীবনটাকে অকল্পনীয় বৈচিত্র্যময় করে সৃষ্টি করেছেন বলে। গল্প এবং স্বপ্নের থেকেও মোহনীয় এবং রোমাঞ্চকর করে এক একটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এখন পর্যন্ত আমাকে জীবনে । আমার জীবনের বাঁকে বাঁকে এত বৈচিত্র্য যা যেকোন রহস্য উপন্যাসকে হার মানায় শিউর।

জীবন একটাই ...... এই এক জীবনে আজকে পর্যন্ত আমি যতখানি জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে অনুভব করে যাপন করে ফেলেছি বহু চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট ঊর্ধ মানুষ তা করতে পারেননি । সত্যি ই !

আমার আশেপাশে আমার সমবয়সী নারীদের মতো গড়পড়তা একটা জীবন তৈরি করে দেননি বলে আমি কৃতজ্ঞ আমার স্রষ্টার উপর। আমার নিজেকেই আমার পথ তৈরি করে নিতে হয়, হয়েছে। অবশ্য জন্মসূত্র অসাধারণ একটা পরিবার দেবার জন্যও ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তাকে। যে পরিবারটি আমার শক্ত মজবুত মানসিকতার ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়েছিল বালিকাবেলাতেই।

অবশ্য প্রথম প্রথম যে আমার রাগ অভিমান হতো না তা কিন্তু নয়।ভীষন অভিমান হতো। চিৎকার চেঁচামেচি করে কত যে কেঁদেছি--- কেন এত বিশ্রী কষ্টকর একটা জীবন আমার হবে ? কেন ? কি লাভ হলো 'ভালো মেয়ে' হতে চাইবার হাস্যকর সব চর্চা করে ছোটবেলা থেকে ? ইত্যাদি ভেবে ভেবে সময় কত যে নষ্ট করেছি তার ইয়ত্তা নেই।

এরপর একটা সময়ের পরে ঠিক বুঝে গেলাম --- আমাকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্ল্যানটা ঠিক ছকে বাঁধা নয়। একসেপ্টও করে নিলাম বাস্তবতাটুকু। ব্যাস তখন থেকেই জীবনের মিরাকলগুলো অনুভব করতে শিখে নিলাম। নিজের ভেতরকার অফুরন্ত পজেটিভ প্রাণশক্তি ই হয়ে উঠলো চালিকাশক্তি আমার একার জীবনটাতে। নিজের ভেতরেই যেন আমি পেয়ে গেলাম আমার মহান স্রষ্টাকে। প্রচন্ড মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে যিনি সর্বক্ষণ অবলোকন করে যাচ্ছেন এই ক্ষুদ্র বান্দাকে। তখন থেকেই সুখ শান্তি আর স্বস্তির পার্থক্য বুঝে ফেললাম আমি , বায়োলজিক্যাল এইজ হিসেবে উপযুক্ত বয়সের বহু আগেই বৈষয়িক হিসেব না বুঝলেও পৃথিবীর চরমতম সত্য "আমার জীবনটা শেষ পর্যন্ত আমার ই। এর সমস্ত দেনা পাওয়া শুধু এই দুনিয়াতেই না বরং মহান ঈশ্বরের সামনেও জীবনের পাই পাই হিসেবটুকু পর্যন্ত আমাকেই দিতে হবে। জেনে গেলাম আমি।"

Image may contain: 3 people, including Nasimon Nahar, people smiling, closeup and outdoor


বই মেলায় সুহৃদ পাঠকদের সঙ্গে লেখকের ছবি।

 

(দ্বিতীয় পর্ব)

আমার প্রাণের শহর পদ্মা পাড়ের ছোট শান্ত নিরিবিলে ফরিদপুরে শুরু হয়েছিল আমার জীবনে রোজার মাসের। আব্বু আম্মু আর বোনদেরসহ আমাদের হৈচৈ কলকালকিতে মুখরিত পুরানো দিনের ঐতিহ্যের ধারক বিশাল বাড়ির প্রতিটি ইন্চিতে মায়া মমতার বন্ধনে,আশেপাশে চাচা ফুপু এবং এক রাজ্যের এলাকাবাসী, না না......পুরো শহরটাই তো ছিল আমার পরিচিত আত্মার খুব কাছের মানুষগুলোর সাথে; অসাধারণ কান্না পাবার মতো সুন্দর এক একটা রোজার মাস জীবনে কাটিয়েছি মেডিকেল কলেজে আসার আগ পর্যন্ত।

নব্বই দশকের শেষের দিক জুড়ে আমার মেয়েবেলা।
সেসময় রিক্সায় করে মাইকিং হতো--- "ওঠেন ওঠেন ভাইসাবরা সেহেরী খান, সেহেরী খান। আর মাত্র বাকী পনেরো মিনিট ......উঠে পড়ুন ঝটপট." সাথে চলতো ইসলামিক গান। আমি আর আমার বোনেরা মিলে বারান্দা থেকে দেখতাম রিক্সায় করে মাইকিং করা ছেলেগুলোকে।মনে হতো ইস কি মজা ওদের। শীতের সময়ে হুডি চাদরে নিজেদেরকে মুড়ে ওরা এই কাজ করত। শেষ রোজাতে একটু একটু মায়া হতো ছেলেগুলোর জন্য। এক বছর অপেক্ষা করতে হবে আবার----" ওঠেন ওঠেন ভাইসাবরা" সেহেরির খান শুনতে। ঠিক মনে পড়ে না কত বছর বয়স থেকে সেহেরির এই আহ্বান আমার রক্তে মিশে গেছে। এখন যেখানে থাকি তা হচ্ছে রীতিমতো গহীন বন বাদাড়। প্রথম সেহেরীতে কান পেতে ছিলাম মাইকিং শুনব বলে। মনে হয় আজন্ম লালিত এই কাজটা প্রতি রোজার রাতেই করে যেতে হবে আমায়।

আমাদের ছেলেবেলাতে ঘরে তৈরি ইফতারের রেওয়াজ ছিল। মনে পড়ে না তখন ইফতারির দোকান বলে কোন কিছু ছিল কিনা ফরিদপুর শহরে। আজও মনে আছে শেষ রাতে সেহেরির সময়ে আম্মু উঠতে সবার আগে। তরকারি রাতে রান্না করে রাখা হলেও ভাত হতো শেষ রাতে রান্না।গরম ভাত নাহলে যেন হতো না। তরকারি দিয়ে খেলেও দুধ কলা দিয়ে ভাত না খেলে সেহেরি যেন অপূর্ণ থেকে যেত। সেহেরির দোয়া আব্বু সাথে সাথে পড়ে নিতাম আমরা। তখন থেকেই অপেক্ষা শুরু হতো ইফতারির। বাসার কাজে সাহায্য করা মেয়েদেরকে বলত ছোলা আর ডান ভিজিয়ে রাখতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ কোরান পড়তাম আমরা বোনেরা।একটু যখন বেশি ছোট ছিলাম তখন তো দিনে দু তিনটা রোজা করে ফেলতাম। হিহি ! বড়রা বলতো দুপুরে খেলে একটা রোজা হয়ে যাবে আমাদের। আবার ইফতার করলে দুটো রোজা।

ছোটবেলাতে রোজা রাখার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা ছিল। মানে প্রথম আর শেষ রোজা রোজা করলেই নাকি পুরো রোজার মাস কে বেঁধে ফেলা হয়। আর একটু বড় হলে বলা হলো সাতাশে রোজাটা করতে পারব আমরা।

দুপুর গড়ালেই কেমন একটা উৎসব উৎসব ঘ্রান বের হতো চারপাশ থেকে। আম্মুসহ আশেপাশের বাসার সব চাচি,ফুপু, আন্টিরা হেঁসেলে ঢুকে যেতেন। আমার মা'র হাতের রান্না খুবই মজাদার। ইফতারে আইটেমগুলো জাষ্ট অমৃত হয় আম্মুর হাতে। সারাদিন রোজা করে আমাদের সবার জন্য ইফতার বানাত আম্মু, এখনো বানায়। চিড়ে ভিজিয়ে রাখা হতো ঘন সর পড়া দুধ দিয়ে, এর উপরে চাক চাক করে কলা কেটে ছড়িয়ে দেয়া হতো। সাথে কয়েক টুকরো বাতাসা। কি যে মজার একটা খাবার। হরেক রকম বাহারি সিজনাল ফল থাকতো। তবে খেজুর অবশ্যই থাকতো। সরবত হতো কয়েক রকম।এছাড়া পেয়াজু,বেগুনী,ছোলা আর মরিচ ভাজা অবশ্যই থাকতো সব সময় ইফতারে। পিঠাও থাকতো কখনো কখনো।আমাদের বাসাতে আরেকটা ট্রাডিশন ছিল-- রোজ ই স্পেশাল ডিনার আইটেম। কোনদিন হতো পরোটা মাংস,কোনদিন চালের রুটি,ছিদ রুটি বলে এক ধরনের পিঠা বানানো হয় আমাদের ফরিদপুরে। ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত রুমাল সেইপের পিঠা।মাংস দিয়ে খেতে হয়।কি যত্ন নিয়ে যে আম্মু তৈরি করতো এসব।এছাড়া বিরিয়ানি,খিচুড়ি ,পোলাও তো হতোই।

আরো একটা ট্রাডিশন ছিল রোজার সময়ে। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের বাসায় ইফতার পাঠানো। তারাও পাঠাত আমাদের বাসায়। আমাদের বাসাতে কয়েকজন হিন্দু ভাড়াটে থাকতেন, প্রতিবেশী হিসেবে আরো কয়েক ঘর হিন্দু কাকা কাকী, আমার অংকের শিক্ষক ছিলেন।তাদের বাসাতেও ইফতার পাঠানো হতো।ওনারাও সাদরে গ্রহণ করত তা। কি যে
আনন্দময় ছিল সবাই মিলে মিশে কাটানো ছেলেবেলার সেই সময়গুলো।

সত্যি বলতে কি এখন মনে হয় ঐগুলো হয়তো বাড়াবাড়ি ছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম ট্রাডিশন। হয়ে এসেছে বছরের পর বছর ধরে। আরো একটা ট্রাডিশন ছিল রোজার সময়ে আমাদের বাড়িতে। ইফতার সব সময় করা হতো আব্বু আম্মুর বেড রুমে বড় চাদর ফ্লোরে বিছিয়ে সবাই মিলে একসাথে বসে। আব্বু আম্মু বোনেরা সবাই আর আম্মুকে কাজে সাহায্যকারীরা। খুব আনন্দ হতো এভাবে খেতে। বছরের আর কোন সময়ে ডাইনিং টেবিল ছাড়া খাওয়া একদম এলাও ছিল না আমাদের বাড়িতে। আমার মা খুব পরিপাটি স্বভাবের। আমাদের বাসার সবকিছু একেবারে নিখুঁত করে সাজানো। খানিকটা ছবির মতো। ছোটবেলা থেকে আমরাও এতে অভ্যস্ত। ঘর বাড়ি এলোমেলো করি না আমরা।

ইফতারিতে বসে আব্বু মোনাজাত ধরত আমাদের সবাইকে সাথে নিয়ে। অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে যেত তখন। আমাদের এলাকার মসজিদটি একেবারে আমাদের বিল্ডিং ঘেঁষা। খতম তারাবী হতো সেখানে। এলাকার সব মুসুল্লী দল বেঁধে যেতেন মসজিদে। আব্বু কখনো তারাবী পড়া বাদ দিত না। বাসায় কেন পড়ে না তারাবী এই প্রশ্ন করে জেনেছিলাম যে কোরান খতম দেয়া হয় তারাবী নামাজের সময়ে। তাই তারাবী বাদ দেয়া সম্ভব না। তারাবী নামাজের সময়ে আমাদের পুরো এলাকাটা না অদ্ভুত নিরাবতায় ছেঁয়ে যেত। সুনসান পিনপতন নীরবতা যাকে বলে। সাধারনত সাতাশে রোজাতেই খতম তারাবী হয়ে যেত আমাদের মসজিদে। ইদ ইদ আনন্দ আমাদের শুরু হয়ে যেত। সাতাশে রোজাতে হাতে মেহেদী পড়তাম আমরা দলবেঁধে।

পেছনে ফিরে দেখার অদ্ভুত এক অভ্যাস আছে আমার। সিনেমাতে যেমন দেখায় সেরকম চোখ বুঁজে আমি ঘুরে আসি আমার ছেলেবেলা থেকে যখন মন চায়। সব সময় যে পারি তা না। খুব করে মনোযোগ দিয়ে একটা বিন্দুতে একনিষ্ঠ হতে হয় আমাকে। তারপর কয়েক মিনিটের অতীত পরিভ্রমণ করি ।যখন চোখ খুলি টপ টপ করে দুচোখ গড়িয়ে জল ঝরে গাল বেয়ে।

আমাদের এখানে বোর্ডিং এ থাকা বাচ্চাগুলো একদিন আমার মতো বয়সে পৌঁছুবে। ওদের মধ্যে কারো হয়তো ইচ্ছে হবে আমার মতো করে অতীত ভ্রমণের। ওদের রোজার সময়ে সেহেরির ফ্লাশব্যাকে ওরা দেখবে সিনিয়র, জুনিয়র, বন্ধু, স্যার আর মিস'দের সাথে ডর্মের ডাইনিং হলে সারিবদ্ধ ভাবে বসে সেহেরির করছে। ক্লাস থ্রি থেকেই ওরা এক একজন হয়ে উঠছে নিজ নিজ জীবনের দায়িত্ব নেয়া এক একজন পূর্নাঙ্গ মানুষ। আমার বা আমাদের মত সহজ সরল চিন্তামুক্ত মা বাবা ভাই বোন পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন জড়ানো শৈশব টা সম্ভবতঃ ওদের হবে না। হয়তো এই পরিবর্তনটুকু সময়েরই দাবী !

(চলবে)


# ডা. নাসিমুন নাহার মিম্ মি । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়