Ameen Qudir

Published:
2017-09-25 15:35:04 BdST

ফিরে দেখা : ভারতের ইতিহাস


 

 

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

__________________________________


গৌতম বুদ্ধের সন্ন্যাস জীবন স্ত্রী - সঙ্গ বর্জিত । ' ন চ পশ্যেৎ মুথং স্ত্রীসাং ন তিষ্ঠৎ তৎসমীপৎ ' -- এই শাস্ত্রবাক্যের নির্দেশ সম্ভবতঃ তিনি মানতেন না । কারণ সন্ন্যাস জীবনে তিনি মাতার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলেছেন , শিষ্য ' যশের ' স্ত্রী কে ধর্মোপদেশ দিচ্ছেন , এমনকি রাহুল মাতার কাছেও ভিক্ষা নিচ্ছেন --- এমন সব বর্ণনা ও তাঁর জীবনীতে আছে । স্ত্রী জাতির সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘ সন্ন্যাস জীবনে দীর্ঘদিনের একটা দ্বন্দ্ব ছিল বলে মনে হয় , তাই হয়তো জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি সন্ন্যাসিনী দের পৃথক সঙ্ঘারাম স্থাপনের কথা বলে যান । তবে তাঁর নির্দেশ -- সন্ন্যাসী কে ব্রহ্মচারী হতে হবে এবং স্ত্রী সঙ্ঘ বর্জিত জীবন । আরো উল্লেখ্য যে এই গৌতম বুদ্ধ -ই অলিখিত ভাবে কিন্তু পরবর্তী কালের ভাবশিষ্য বিবেকানন্দের বিবেক - আনন্দ ।

 

থেরবাদী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা শুধু বর্ষার চারমাস সঙ্ঘারামের গুহা - কন্দরে বাস করতেন । বাকি আট মাস ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষুদের আশ্রয়স্থল বৃক্ষতলে । মাথার উপর একটি ছাদ থাকলেই বাসনা জাগবে চালের উপর লাউডাঁটা টা তুলে দিতে । সখ হবে বাগানের , দুগ্ধবতী গাভীর । ফলে অনিবার্য হয়ে পড়বে সব কিছু দেখভাল করার জন্যে এক ধর্মসঙ্গিনীর । ক্রোধের মত কাম কে কেই বা
অস্বীকার করতে পেরেছেন ?


তাই আজ মনে হয় -- সন্ন্যাসী বলতে যা বুঝি --সংসার ত্যাগী , লোটা কম্বল ধারী বৃক্ষতলবাসী ব্রহ্মচারী -- তার গঙ্গোত্রী ঐ বুদ্ধদেবের সঙ্ঘ । স্বীকার্য , হিন্দুধর্মে স্ত্রী সঙ্গ বর্জিত ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষাজীবি সন্ন্যাসী প্রাকবুদ্ধকালে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য হলেও জৈনধর্মের ২৩ জন সংস্যারত্যাগী তীর্থঙ্কর বুদ্ধদেবের অগ্রজ । হয়তো বা বুদ্ধদেব এই সব পরিব্রাজকের জীবনযাত্রায় বেশী আকৃষ্ট হন , হিন্দু সন্ন্যাসী দের দেখে নন ।
তারপর হাজার বছর ভারতীয় ধর্ম বহু শাখায় বিভক্ত হয়েছে । এক এক সম্প্রদায় এক এক পথে চলেছেন । বৌদ্ধধর্মে বজ্রযান , মহাযানে বিভক্ত হয়ে ফিরে আসছিলো সেই বুদ্ধমূর্তি পূজা , এলো তান্ত্রিক পঞ্চ ম কারের ছায়া পড়তে লাগলো -- সে এক গভীর অনিশ্চিত সময় । দিগদর্শক বা মার্গদর্শক এর ঘোর অনটন -- অথবা সকলেই দিগদর্শক বা মার্গদর্শক । ভারতব্যাপী অবক্ষয় যখন তুঙ্গে ( সেই যদা যদা হি ধর্মস্যগ্লানির্ভবতি ভারতঃ ?) তখনি আবির্ভূত হলেন এক অবতার -- গ্রেগরিয় অষ্টম শতকে -- মুসুলমান আগ্রাসনের পূর্বেই -- দাক্ষিণাত্যে আবির্ভূত হলেন দন্ডীধারী আচার্য শঙ্কর ।

 

অসীম তাঁর প্রতিভা --অপরিসীম তাঁর প্রতিভা ,জ্ঞান ও মেধা । তিব্বত সহ সমগ্র ভারত পরিক্রমা করে সেই দন্ডী সন্ন্যাসী পরাজিত করলেন অন্যান্য সম্প্রদায়ীদের । কুসংস্কারের মূলোচ্ছেদ করলেন তিনি । প্রতিষ্ঠা করলেন --- উত্তর মীমাংসা দর্শন জাত সম্ভূত অদ্বৈত -- বেদান্ত মতবাদ । ভারতের চার কোণে প্রতিষ্ঠা করলেন চারটি মঠ --- চারি বেদের চর্চার জন্য । পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষী সম্প্রদায় কে একসূত্রে গেঁথে দিলেন ।
শঙ্করাচার্যের জীবনী তে সবচেয়ে বড় ধাঁধাঁ তাঁর জীবনের স্বল্পতা । মাত্র বত্রিশ বছরের মধ্যে কেমন করে এই কাজ টি করলেন ? ৭৮৮ খ্রীস্টাব্দে জন্ম কেরলের কালাডি গ্রামে । কৈশোরেই প্রব্রজ্যা । শঙ্কর কৈশোর কালেই বেদ বেদান্ত সমেত সমস্ত হিন্দু শাস্ত্র পড়ে ফেলেছেন । না ভুল হোলো অবগাহন স্নান করেছেন । এরপর পড়লেন বৌদ্ধ ধর্ম -- জৈন ধর্মের আকর গ্রন্থ গুলি । তিনি নিজে গ্রহণ করলেন -- উত্তর মীমাংসাদর্শন সম্ভূত অদ্বৈত বৈদান্তিক মতবাদ গ্রহণ করলেন । ঘোষণা করলেন অপরিসীম দার্ঢ্যে ---- " প্রবক্ষামি শ্লোকার্ধেন যদুক্তম গ্রন্থকোটিভিঃ " --- বিভিন্ন কোটির ধর্মগ্রন্থে যা বলা আছে তা আমি অর্ধেক শ্লোকেই বলতে পারি । সেই সত্য হল --" ব্রহ্ম সত্য -- জগৎ মিথ্যা "।

 

এই অদ্বৈত - বেদান্ত ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে করতে যখন তিনি ভারতপরিক্রমায়
বেরোলেন তখন তিনি বিংশতি বর্ষের এক তরুণ । তিব্বত ও কাশ্মীর সমেত সারা ভারত পরিক্রমা করলেন যে এই দন্ডী সন্ন্যাসী -- এটি আগেও লিখেছি । একের পর এক বিচারসভায় অন্যান্য সমস্ত মত কে খন্ডন করলেন এই দন্ডী সন্ন্যাসী এবং বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিজয় পতাকা পুনরুড্ডীন করেন । বস্তুত , এর পরেই বৌদ্ধ ধর্ম ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে এবং মূল ভূখন্ড থেকে পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে ।


তার পর এই শঙ্কর আর কি কি করলেন -- ভারতের চারটি তীর্থস্থানে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন । প্রতিটি স্থান -ই হিন্দু ধর্মের স্বীকৃত পূণ্যভূমি । তিনি চারটি মঠেই যোগ করলেন এক এক জন দেবতা -- নইলে অদ্বৈত-- বেদান্ত ধর্ম খায় না মাথায় মাখে -- পরে অনেকে হয়তো বুঝেই উঠতে পারবেন না । দ্বারকায় == সিদ্ধেশ্বর , পুরীতে == জগন্নাথ , বদ্রীকাশ্রমে == নারায়ণ আর রামেশ্বরে ==আদি বরাহ । চারটি মঠে চার তীর্থস্থানের ব্যবস্থা । অলকানন্দা , গঙ্গা আর তুঙ্গভদ্রা হচ্ছে নদী আর শুধুই পুরী তে সমুদ্র ।
এছাড়াও আর কি করলেন সেই বিস্ময় - নবযুবক ? তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অবতার বুদ্ধদেবকে বিষ্ণু্র নবম অবতার রুপে গ্রহণ করলেন । বৌদ্ধধর্মের তদানীন্তন ব্যভিচারের বিরুদ্ধেই তাঁর যুদ্ধ ( জেহাদ বা জিহাদ শব্দটি ইচ্ছে করেই আনিনি -- কারণ এই আরবি শব্দ বোঝার মানুষ তখন পর্যন্ত এই ভূখন্ডে ছিলই না । ), স্বয়ং গৌতমবৌদ্ধ কেই তিনি বিষ্ণুর অবতারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন ।।
যদিও তিনি অদ্বৈত - বেদান্তিক , তবু তাঁর শিষ্যরা অধিকাংশই শৈব । সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে দশনামী শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে চারটি মঠের অধীনে নিয়ে এলেন । মঠবাসী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেললেন । তাঁর রচিত উপনিষদ -ভাষ্য , বেদান্ত ভাষ্য ,গীতা ভাষ্য ব্যতীত আজো শাঙ্করভাষ্যের কুন্চিকা ব্যতিরেকে ( জ্ঞান -শলাকা বা চলতি ভাষ্যে - চাবি ) আজও বেদ উপনিষদ রুদ্ধদ্বার ।

__________________________________

লেখক ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় । কলকাতার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC)

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়