Ameen Qudir

Published:
2017-09-23 16:21:38 BdST

বায়বীয় ভালোবাসা :বিশ্বাসহীন স্পর্শের হাজার জীবন বনাম প্রেমময় একটি বিকেল


 

 

 

ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী

________________________________

আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার বড় ভাইয়ের প্রাক্তন স্ত্রীর ফ্ল্যাটের দরজায়।কলিংবেলের সুইচে হাত রেখে বার বার ইতস্তত করছি।হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে এসেছি আমি।
এসেছি একটা ছোট্ট ক্যালকুলেশন এর ফলাফল বের করতে ভাবী,সরি মোনা আপু - সে তো আর ভাবী নেই আমার, হেল্প নিতে।
কিন্তু এতদিন পর!ঠিক কিভাবে নেবে মোনা আপু বা তার বাসাতে অন্য কে আছে,এসব ভেবেই আনইজি ফিল করছি।


ভাইয়ার সাথে মোনা আপুর এরেঞ্জড ম্যারেজ ছিল।কেউ কাউকে চিনত না,জানত না।হঠাৎ বাবা মা পাত্রী দেখলেন।পছন্দ হলো।খুব ধুমধাম করে বিয়ে।ওরা ভীষন সুখী কাপল ছিল।দুটো বছর আমি ওদের কেবল ঘুরে বেড়াতেই দেখেছি।
তখন আমি স্কুল ছাত্রী।বড়দের ব্যাপার অত বুঝিও না।হঠাৎ খুব ঝামেলা হলো।রোজ ঝগড়া।কান্নাকাটি।মিটিং!


ওদের ডিভোর্স হয়েছে আজ নয় বছর।এরপর দুজনের ই আবার বিয়ে হয়েছে।ভাইয়া এখন বেশ স্ট্যাবল।পরিপূর্ন সুখী পুরুষ।বউ,বাচ্চা,অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট,গাড়ী!মাসে মাসে বিলেত ট্যুর,ভুড়ী!


মোনা আপুও হয়ত সুখী!যদিও জেনেছি ওর বর বছর খানেক আগে কি এক কঠিন অসুস্থতায় মারা গেছে!
সাত পাঁচ ভেবে কলিংবেল রিং বাজিয়েই ফেললাম।দরজা খুলল মোনা আপু।
আমাকে জড়িয়ে ধরল।
- বেশ বদলেছি।কি করে চিনলে?ফেসবুকে দেখেছি।মিচুয়াল আছে তোর বন্ধুদের সাথে।তোকে দেখি।কি ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করছিস ভার্সিটিতে!


- তুমি বেশ রোগা হয়েছ।কালো ও।
- বেশ মুটিয়েছিলাম প্রেগনেন্সীতে।লুজ করেছি।খাঁটুনী যাচ্ছে খুব।ব্যাংকের চাকরী!বুঝিস ই তো!
মোনা আপু সহজ আচরন করলেও একটু যেন ইতস্তত।আমার হঠাৎ এই আগমনের হেতু খুঁজতে হয়ত।এর মাঝেই বছর পনেরের এক মেয়ে একি পোষাক পরা দুটো ফুঁটফুঁটে বাচ্চা নিয়ে বেরোল।
- তোমার টুইন মেয়ে।কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে!
- হুম।আজ শুক্রবার।পাশের গলিতে একটা গানের স্কুল।ওখানে গান শিখতে যায়।


মোনা আপুর সাথে একটু সহজ হয়ে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।কোন ভনিতা না করেই।
- আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাবা।ছেলেটি পুলিশে কাজ করছে।এএসপি।ভীষন সুন্দর দেখতে।মানিকগঞ্জে পোষ্টিং।ফ্যামিলি ঢাকাতে।বড় চাচার বন্ধুর ছেলে।


- তো??বিয়ে করে নে!
- তুমি ও তো করেছিলে!!
তুমি সৌরভ কে মনে করতে পারো?আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড।প্লে থেকে বেষ্টি।অনার্সে এ ও সেম ভার্সিটি।
আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি।রিলিজিয়ান আলাদা।অনেক ভেবেছি ছাড়ব।বাবার পছন্দে বিয়ে করব!
কিন্তু,ওকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেও পারি না।তোমার আর ভাইয়ার সেই ঝগড়ার দিনগুলি মনে পড়ে!


ভাইয়াকে তুমি কেন ছেড়েছিলে?
ঠোঁট টিপে অনেকক্ষন নীচের দিকে চেয়ে থেকে এক সময় মোনা আপু বলল!
- আমি তোর ভাইয়াকে বিয়ে করেছিলেম।লোকে দেখত,সুখী ছিলাম।কিন্তু আমাদের আন্তরিকতা ছিল না।বন্ধুত্ব,পারস্পরিক বোঝাপড়া,শ্রদ্ধাবোধ কিছুই ছিল না।
আমি প্রথমে দিনাজপুর মেডিকেল এ এডমিশন নিয়েছিলাম।ওখানে রুম্মান ফিফথ ইয়ার ছাত্র ছিলেন।এডমিশনের মাস খানেক পরে সে আমাকে প্রপোজ করে।উত্তর দেবার আগেই টাইফয়েড জ্বর হয়ে ব্যাক টু ঢাকা।ডাক্তারী পড়া শেষ!
এক বছর পর ডিইউ তে এডমিশন নেই।ঐ ইভেন্ট ভুলেই গেছিলাম।
তোদের দাদী স্ট্রোক করার পরে হসপিটালাইজড হবার পরে ওখানে রুম্মান এবং দুজন বন্ধুর সাথে দেখা।ওরা ডিউটি ডাক্তার।ফান করে ঐ কথা বলল।
এরপর থেকে তোর ভাইয়ের অন্য রূপ।রোজ মার।গালা গালি।অসহ্য অত্যাচার।হি ওয়াজ অবসেসড এবাউট মি।অবসেশন আর ভালোবাসা এক নয়।

 

একদিন ওর বন্ধুর ছেলের জন্মদিন পার্টিতে সবার সামনে যাচ্ছে তাই বলল তোর ঐ মুখচোরা ভাই।কেঁদে কেঁটে বাবার বাসায় এলাম।তারপর ডিভোর্স লেটার পেলাম।
এরপর ফারাবীর সাথে পরিচয়।প্রেমে পড়লাম।বিয়ে করলাম।দুই জমজ কন্যার জন্মের বছর খানেক পর হঠাৎ ই ভীষন অসুস্থ হলো সে।জানলাম তার ক্যান্সার।
আমি ফারাবীকে ভালোবেসেছি।এরপরে বুঝেছি আমি আসলে তোর ভাইকে কখন ও ভালোই বাসিনি।একটা শিক্ষিত মেয়ে,একটা কালচারাল মেয়ে কেবল শারিরীক সম্পর্ক আর ঝগড়া,সন্তান জন্ম দিতেই বিয়ে করে না।বিয়ে মানে দুটো মানুষের বন্ধুত্ব!পারস্পরিক বোঝাপড়া।
ফারাবীর সাথে আমার মাত্র চার বছরের সংসার।এর মাঝে ওর ক্যান্সার ধরা পরল।দুটো পরীর মতো বাচ্চা অযত্নে পরে কাঁদত।রোগা স্বামী!তার মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনেছি।তবু ভালোবাসার কমতি হয়নি।

 

ভালোবাসা,বিশ্বাসহীন স্পর্শের হাজার জীবনের থেকে ভালোবাসার মানুষের সাথে কাটানো প্রেমময় একটি বিকেল,একটি রাত মূল্যবান!
আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের ঠিকানায়।ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়ে গেছে।জীবনের একটাই সংজ্ঞা,ভালোবাসা আর বিশ্বাসের অনবদ্য সংমিশ্রন।ভালোবাসা থাকলে বন্ধুত্ব থাকলে সব থাকবে।আর ভালোবাসা হারালে নিঃস্ব হবো!
মোনা আপুর শেষ কথাটা কানে বাজছে,ফারাবীকে আমি ধরে রাখতে পারিনি।কারন ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা আমার ভাগ্যে নাই।তবে তার ভালোবাসা আমাকে সারাক্ষন ঘিরে থাকে,আলো হয়ে,বাতাস হয়,তার দুই অসহায় কন্যার মমতা হয়ে।

____________________________________

 

ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী

বরিশাল ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়