Ameen Qudir

Published:
2017-09-10 17:02:27 BdST

আনন্দ্রাশ্রু


 

 

 

 


ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী

___________________________________

একসাথে আমার জীবন আকাশের চাঁদ সূর্য দুটোই হারিয়ে গেল।আমি অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম।
আমার গল্পের শুরুটা বেশ আগের।আমার আব্বা যখন স্নাতকোত্তর এ তৃতীয় শ্রেনীতে পাস করে শহরে কোন ভালো চাকরী না পেয়ে গ্রামে এসে গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করতে শুরু করলেন,আমার বড়লোক নানার সুন্দরী আধুনিক কন্যা তার ছাত্রী হয়ে যান।স্কুলের মাওলানা,তাবলীগ করতেন,চিল্লা যেতেন আব্বা।আর মা গাদা খানেক ছিনেমা দেখে বেড়াতেন।নানা মেয়ের সুশিক্ষার জন্য আমার আব্বার সাথে তার উড়নচন্ডী মেয়ের বিয়ে দেন।
আমার আব্বা মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন।কিন্তু মা আব্বাকে সহ্যই করতে পারতেন না।আগের তিন বোনের পর আমার যখন জন্ম হলো মা আব্বাকে খুব গালি দিতেন,কেন তার এত মেয়ে হলো!


আমার বড় তিন বোন ভীষন মা ন্যাওটা।কিন্তু আমি এতটাই অনাকাঙ্খিত ছিলাম যে মা আমাকে দেখতেই পারতেন না।মার গ্রাম্য অসচ্ছল জীবনের জন্য তিনি আব্বাকে দায়ী করতেন।আব্বা তাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকতেন।
কিন্তু আমার প্রতি মায়ের অযত্নে আব্বা আমাকে সযত্নে কোলে তুলে নিলেন।সেই থেকে আমি আব্বার আদরে মানুষ।পড়াশুনা অনেক করেছি।কিন্তু স্কুলের গন্ডি পেরোইনি।আব্বা লাইব্রেরীর সব বই আমাকে পড়াতেন।

 

 


বড় তিন বোন আব্বার সাথে যুদ্ধ করে কলেজে পড়েছে।বড় আপা চাকরী বাদ দিয়ে পার্লার বিসনেস করছে।দুলাভাইর কসমেটিকস সপ।মেজো বোন খালাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করে ঢাকা গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে।সেজ বোন ঢাকাতে ব্যাংকে চাকরী করে।কলিগ বিয়ে করেছে।তারা সবাই সুখী।কিন্তু আব্বা কারো সাথে কথা বলেন না।


এই সব কারনে আব্বা একটু গম্ভীর আর মা আরো রগচটা!তখন এলাকার কলেজে ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষকের সাথে আমার বিয়ে দেন আব্বা।ছ মাস আগে উনার বউ উনাকে ছেড়ে চলে যান।লোকে বলে বউ চাকরী করবে।আর তিনি করতে দিবেন না বলে এই বিবাহ বিচ্ছেদ।আমি যদিও তার আগের বউকে নিয়ে তাকে জীবনেও কোন কথা বলিনি।সেও বলে না।তবে মাঝে মাঝে উৎসবের দিনগুলিতে একা ছাদে দাঁড়িয়ে কাঁদেন তিনি।আমার শাশুরী বলে বউকে নাকি তিনি বড্ড ভালোবাসতেন।আমার ধারনা তিনি আমাকেও খুব ভালোবাসেন।আর সবথেকে বেশী যাকে ভালোবাসেন সে আমার জমজ পুত্রের পর জন্ম নেয়া কন্যা।
ভীষন রকমের স্বচ্ছল আমার জীবন।বোনদের মত স্বাধীন সাবলম্বী আমি কখন ও ছিলাম না।কিন্ত জীবন জুড়ে ভালোবাসার অভাব ছিল না।
যেদিন আমার আব্বা আর স্বামী চিল্লা থেকে ফিরবার পথে একসাথে বাস এক্সিডেন্টে মারা গেলেন,সেদিন থেকে পৃথিবীতে আমার জন্য অক্সিজেন কমে গেল।সবার হৃদয় থেকে স্নেহ,দরদ,ভালোবাসা সব কমে গেল।
সারাক্ষন আমার গুনের প্রশংসা করা মানুষগুলিই আমাকে দুর্ভাগা আখ্যা দিতে লাগলেন।জীবনে প্রথম বার অভাব চোখে দেখলাম।

 

 


তিন তিনটে বাচ্চা,কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না।চোখে অন্ধকার দেখছি তখন।মা এসে পাশে দাঁড়ালেন।কিছু আত্মীয় এমন সব প্রস্তাব দিলেন,যেসব উপায়ে টাকা উপার্জনের পথ কল্পনাতেও আনিনি।অথচ তিন টে মাসুমের দায়িত্ব আমার উপর।
মায়ের বাসার বারান্দায় তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ুয়া চারটে মেয়েকে টিউশন দিতে শুরু করলাম।এই শুরু।ধীরে ধীরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে রইল।আজ আমার অনেক বড় কোচিং সেন্টার।এখানে সব ভাগ্যহত,বেকার নারীদের ই এনেছি।সাতজন মিলে চালাই।একটা অংশ আবাসিক।মায়ের আদরে যত্নে দশটি মেয়ে আবাসিক থাকছে।আমার ছেলে মেয়েরা আজ স্কুলে পড়ছে।পেট ভরে ভাত খাচ্ছে।আমি তাদের জন্য সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছি।
পৃথিবীর জীবন টা বড্ড অদ্ভুত।বিনা ঘোষনায় কে কখন কক্ষপথ থেকে ছিটকে কোন সূদুরে চলে যায় কে জানে!নারী পুরুষ যেই হোক, স্বাধীন এবং স্বাবলম্বী হওয়া কোন কিছুর সাথে সাংঘর্ষিক না।তাই সময় থাকতেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়,পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য।আজ অসীম সাহসী মা আমার পাশে না দাঁড়ালে আমি ভেসে যেতাম।হয়ত অনেকেই যায়,,যার খবর আমরা রাখি না।

 


মৃত মায়ের ডায়েরী পড়তে পড়তে চোখ মুছল ডাঃ তোফা!অনেক কষ্ট করে মা তাদের তিন ভাই বোনকে বড় করেছেন।তার জীবনের একটাই স্বপ্ন ছিল,তার সন্তানরা উচ্চ শিক্ষিত হবে।সৎ এবং স্বাবলম্বী হবে।আজ ওরা তিন জন ই উচ্চ শিক্ষত!চাকুরীরত!
তোফার আজ রেজাল্ট দিয়েছে।সে রেডিওথেরাপীতে এ এমডি,বড় ডিগ্রী করেছে।তিন বছর আগে ক্যান্সার তার মায়ের জীবন কেড়ে নিয়েছে।দেশের হাজার হাজার ক্যান্সার রুগীর মাঝে তোফা এবার তার দুরারোগাক্রান্ত মাকে খুঁজে ফিরবে।রোগীদের সুস্থ করে বাড়ী পাঠাবে আর মায়ের জন্য দু'ফোটা আনন্দাশ্রু ঝরাবে!


_______________________________________
ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী


বরিশাল।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়