Ameen Qudir

Published:
2017-03-16 17:45:41 BdST

প্রথম আলো সম্পাদককে এক পেশাজীবী নেতার খোলা চিঠি


 

 

 

ডা, বাহারুল আলম
_______________________________

একটি পক্ষপাতমূলক সম্পাদকীয় – যা চিকিৎসকদের যৌক্তিক প্রতিবাদ ও মানবতার লঙ্ঘনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সুকৌশলে রাষ্ট্রকে ছাড় দেওয়া হল। যার পরিণাম শুভ নয়।


বিজ্ঞ সম্পাদক ( প্রথম আলো ) জনাব মতিউর রহমান, প্রথিতযশা সাংবাদিক । ঘটনার পিছনের ঘটনা তুলে আনার মধ্য দিয়ে সত্য প্রকাশ করাই সাংবাদিকের কাজ।
তিনি স্পষ্টভাবেই জানেন, জনগণের চিকিৎসা দেওয়ার অঙ্গীকার রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। একইভাবে জনগণের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত। রাষ্ট্র চিকিৎসকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে তার জনগণকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। সেই নিয়োগকৃত চিকিৎসকগণ রাষ্ট্রায়াত্ব হাসপাতালে জনবল, অবকাঠামো ,প্রযুক্তি ও উপকরণের অভাবে প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে চিকিৎসা দেওয়ার দায়িত্ব পান। ফলে রোগীদের সন্তুষ্ট ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই সংক্ষুব্ধ রোগী ও তাদের স্বজনরা তাৎক্ষনিকভাবে চিকিৎসককে লাঞ্ছিত করে।

এই লাঞ্ছিত চিকিৎসকরা যখন নিরাপত্তা, মর্যাদা ও লাঞ্ছনার বিচার পায় না, তখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এটি গণতান্ত্রিক আচরণ ও শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে।

রাষ্ট্রের চিকিৎসা দেওয়ার দায়বদ্ধতা সংক্ষুব্ধ চিকিৎসকদের ধর্মঘটের কারণে ব্যাহত হলে কেন চিকিৎসকরা দায়ী হবেন এর ব্যাখ্যা তিনি দেন নি। কোন চিকিৎসকই রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালে মানবিক দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত বা পদায়িত হয় না। তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয় ঐ হাসপাতালে আগত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ নাগরিকদের চিকিৎসা পাওয়ার সমুদয় দায়িত্ব রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার উপর বর্তায়, চিকিৎসক এখানে সহায়ক/পরামর্শক মাত্র। ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোন একটিও চিকিৎসক দ্বারা সৃষ্ট নয়, সবই (বাজেট, পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, অবকাঠামো) সচিবালয়/মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকার ও তার প্রশাসন দ্বারা সৃষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত।

চিকিৎসক তার চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা, নিজ মর্যাদা ও অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, লাঞ্ছনা ও অপমানের প্রতিকারের দাবীতে সংক্ষুব্ধ হয়ে চিকিৎসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, রাষ্ট্র অপরাধী না হয়ে কেন চিকিৎসকরা অপরাধী হবেন এ বিষয়ে জনাব মতিউর রহমান বলেন নি।

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ও অপ্রতুলতা মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করে। সেই ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া মেডিকেল এথিকস বিরোধী এবং অন্যায়। এমতাবস্থায় চিকিৎসকরা চিকিৎসা না দেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রথম আলোর সম্পাদক একমত পোষণ করেন নি। তাঁর কথায় স্পষ্ট হল, ‘ঝুঁকি থাকা অবস্থায় চিকিৎসা না দিলে মানবিকতা লঙ্ঘিত হয়’। সম্পাদকীয়তে তিনি আরও বলেছেন, “ধর্মঘট চিকিৎসকদের প্রতিবাদের পথ নয়”।

কোনটি প্রতিবাদের পথ সেটি মতিউর রহমান বলেন নি। তিনি জানেন, বাংলাদেশে কর্মবিরতি/অবরোধ ছাড়া অন্য কোন প্রতিবাদে রাষ্ট্র/সরকার সাড়া দেয় না।

হাসপাতালে চিকিৎসা দুর্ঘটনায় রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসক নির্মমভাবে লাঞ্ছিত হন। চিকিৎসা দুর্ঘটনা ছাড়াও হাসপাতালের বাইরে যে কোন দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হলে সেই মৃত রোগীকে হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করলেও লাঞ্ছিত হন। রোগীর স্বজনদের মারমুখী হওয়ার বিপরীতে হাসপাতালে কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাই। যারা লাঞ্ছিত করে তাদের বিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রায়শ নিষ্ক্রিয় থাকে। উপরন্তু রোগী মৃত্যুতে চিকিৎসককে খুনের আসামি করে জেলহাজতে পাঠায়। এতসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকারের জন্য চিকিৎসকরা যখন প্রতিবাদী হয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয় তখনই ‘গেল, গেল মানবতা গেল’ -- মতিউর রহমানসহ সকলেই চিৎকার করে ওঠেন।

তিনি একবারও বলেন নি, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার অসঙ্গতি ও ত্রুটির কারণে রোগীদের চিকিৎসার ঝুঁকি, চিকিৎসকের নিরাপত্তাহীনতা, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার বিপরীতে রাষ্ট্রকে আরও কার্যকরভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন নি , রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার, তাদের দায়িত্বহীন বক্তব্যের কারণে জনগণ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে ওঠে। তেরখাদার ঘটনায় তিনি স্পষ্ট করে উপলব্ধি করেছেন, যেই মুহূর্তে ঘটনা ঘটেছে, সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রের প্রশাসন আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারতো। কিন্তু করে নি। গ্রেপ্তার করেছে, তবে চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে যাওয়ার পরে।

রাষ্ট্র এই উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তার মধ্য দিয়ে চিকিৎসকদের প্রতি যে দায়িত্বহীনতা ও অমানবিক আচরণ করেছে, সে বিষয়ে রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে অভিযুক্ত করে কিছুই বলেন নি জনাব মতিউর রহমান।

বিজ্ঞ সাংবাদিক মতিউর রহমান জানেন, রোগীর প্রয়োজনীয় ও পরিপূর্ণ চিকিৎসার মাধ্যমে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। অথচ রাষ্ট্র মানহীন, অসম্পূর্ণ, অকার্যকর চিকিৎসা দিয়ে রোগী ও তার স্বজনদের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ করে তোলে এবং কৌশলে চিকিৎসক ও ক্ষুব্ধ জনগণকে মুখোমুখি করে দিয়ে নীরব থাকে। এ বিষয়েও তিনি কিছু উল্লেখ করেন নি।

চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বিধায় চিকিৎসা দুর্ঘটনায় চিকিৎসকদের ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি ও চিকিৎসক-রোগী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেন নি। সব মিলিয়ে একটি পক্ষপাতমূলক সম্পাদকীয় লিখনির মাধ্যমে চিকিৎসকদের প্রতিবাদ ও মানবতার লঙ্ঘনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সুকৌশলে রাষ্ট্রকে ছাড় দিলেন। যা বিজ্ঞ সাংবাদিক মতিউর রহমানের কাছ থেকে অনভিপ্রেত।

_____________________________

লেখক ডা, বাহারুল আলম । লোকসেবী চিকিৎসক। প্রখ্যাত পেশাজীবী নেতা।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়