Ameen Qudir

Published:
2017-03-14 15:40:36 BdST

বাঙালী যদি শঠ ও খল হত, তাহলে তার জীবনে এই বিপর্যয় হয়ত নেমে আসত না


 

ডা. রেজাউল করীম
______________________________

একজন আমাকে লিখে পাঠিয়েছে, আমি পলিটিক্যাল সুবিধাবাদী। কারন, আগে আমি এস এফ আই করতাম,আর এখন সিপিএমকে "গালি" দি। আমি বলতেই পারতাম, আমরা, এই কয়েক হাজার বা লাখ খানেক বছর আগে লম্বা ল্যাজ্ নিয়ে গাছে গাছে লাফিয়ে বেডাতেম, আর কাঁচা কদলি খোসা না ছাডিয়ে গলধ:করন করতুম। কিন্তু,কঠোর শ্রম আমাদের বানর থেকে মানুষে উত্তরন করেছে। কিন্তু, বেচারাকে ডিসহারটেন করতে চাইনে তাই পলিটিক্স নিয়ে দুচারকথা বলতে চাই। ইংরেজীতে যাকে পলিটিক্স বলে তার বাংলা নামকরন রাজনীতি- কেমন যেন সামন্তবাদের খোঁয়াডের বোঁটকা গন্ধ। অবশ্য, রাজন্যপ্রথার বিলোপ হয়েছে মাত্র , রাজা বিলোপ হয় নি। তাই যাদের রাজা সাজার ইচ্ছে হয় তারা রাজনীতি করে।


বাঙালীর পলিটিক্স নিয়ে বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ সবাই অল্প-বিস্তর লিখেছেন। বাঙলার মাঠ ঘাট যেদিকে তাকান দেখা যাবে পলিটিক্সের কঙ্কাল ছডিয়ে আছে। হিন্দমোটর-সিঙ্গুর ছাপিয়ে কৃষ্ণা গ্লাস, ঊষা, সেন-রাল্যে সর্বত্র ধ্বংসের যে বামিয়ান আমরা সৃষ্টি করে রেখেছি তার জুডি মেলা ভার। আজ নিজেদের কৃতকর্ম আমাদের আর পীড়া দেয় না- এটা এখন butt of joke. আমরা সংঘবদ্ধ ভাবে ম্যাসোকিজমের স্বীকার- mass masochism। জে বি মুখার্জি আমাদের কিছুদিন ফরেনসিক পডিয়েছিলেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা একবাক্যে স্বীকার করবেন- সব বিষয়েই তার কাছে হাতেগরম নানা রকম মজাদার গল্পের অফুরান সাপ্লাই থাকত। একবার, এবংমাত্র ঐ একবারই আমি স্যরকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম- ম্যাসোকিজম মানে কি? স্যর, বলেছিলেন- বাপ! এটা বুঝতে পারিস নি? ম্যাসোকিজম মানে হল- মারো আমায় মারো, আমায় এমনি করে আদর করো!!


অথচ, এমনটি কি হওয়ার কথা? বাঙালীর ছেলে বিজয় হেলায় লঙ্কা করেছিল জয়। বিক্রমপুরের খাস বাঙাল "অগ্নি-কন্দুক" র ব্যবহার শিখতে চিনে গেছিলেন- নয় নয় করে 1000 (982_1054 CE) বছর আগে। সে ও ছিল রাজনীতি। জরাসন্ধ বাঙালী, কর্ণের বাঙালীত্ব নিয়েও বোধহয় খুব সন্দেহ করা চলে না। তাঁরা দুজনেই কৃষ্ণসখা পান্ডবদের বিরোধীতা করেছেন, কিন্তু "বীরের ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট" হয়েছেন, তার প্রমান মহাভারতেও পাওয়া যায় বলে জানা নেই। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত পাঠশালা, চতুষ্পাঠীতে "দাতাকর্ণ" একটি আবশ্যিক পুস্তক হিসেবে বিবেচিত হত। দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয় লিখেছেন- "এই বিষয় লইয়া বাঙ্গালার প্রাচীন কবিরা যত কবিতা লিখিয়াছেন, অন্য কোন বিষয়ে এত অধিক কবিতা লিখিত হয় নাই" (বৃহৎ বঙ্গ, আদি পর্ব পৃ ২৪)। বাঙালী চরিত্রের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা- শৌর্য অপেক্ষা ঔদার্য, বীর্য্য অপেক্ষা মহানুভবতা, ঐশ্বর্য অপেক্ষা ত্যাগেই সে সমধিক আনন্দ পেয়েছে। বিশ্ববিজয়ী বীর বিনা সংকোচে "কবচ-কুন্ডল" দান করে মৃত্যুবরণ করেছেন। কবি কর্ণের জবানীতে লিখেছেন-" যে পক্ষের পরাজয়। সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান/জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডব সন্তান / আমি রব নিষ্ফলের হতাশার দলে.."। তাই দেখতে পায় শশাঙ্ক, তার সম্পর্কে ইতিহাস বিদিত বৌদ্ধ হত্যার নানা লিখিত ইতিহাস থাকা সত্বেও, আরব বনিকদের তাদের উপাসনাগৃহ নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামে জমি দান করেছেন। সেই বনিকরা যখন ১৯ জন ছদ্মবেশী দস্যু নিয়ে বাঙলার রাজধানী জয় করেছে তখন থেকেই আমাদের অধ:পতন শুরু হয়েছে।


বাঙালী যদি শঠ হত, খল হত তাহলে তার জীবনে এই বিপর্যয় হয়ত নেমে আসত না। শান্তনীড বাঙালী যখন লখমানিয়ার শাসনে শান্তচিত্ত অগাধ নিদ্রায় গা ভাসিয়েছে শত্রু এল অবাধে, অক্লেশে- শত গূঢপুরুষ, দৌবারিক, পাত্রমিত্র কেউ বিন্দুমাত্র বুঝতে পারল না সহস্র বছরের লাণ্ছনার সেই শুরুর মূহূর্তটি! কারন, দেশে কোন অভাব ছিল না, চুরি ডাকাতির প্রয়োজন ছিল না, সবাই ছিল বিশ্বাসপ্রবন, পরহিতকারী। তাই অক্লেশে শত্রু পৌঁছে যায় অন্দরে- অশীতিপর বৃদ্ধ রাজা পলায়ন করে। বাঙালীর সেই দুর্ভাগ্যের ইতিহাস ধরা পড়েছে কবিতায় -
অহ! কি কুদিবসে গ্রাসিল দেশ, মোচন হইল না আর ও।
ভাঙ্গিল, চূর্ণিল, উলটি পালটি, লুটি নিল যা ছিল সার-ও।।
সেদিন হইতে অন্ধ মনোগৃহ পরবল অর্গলপাতে-ও।
সে দিন হইতে শ্মশান এ দেশ পর অসিঘাতে নিপাতনে-ও।।
বাঙালী এত রক্তপাত দেখে নি, বিনা কারনে মানুষ মানুষের শিরচ্ছেদ করে এ তার অজানা। তার ছোট্ট ছোট্ট সংসারে শালগ্রাম শিলা, তার তুলসি মন্চ, অথিত-আপ্যায়ন, পালপার্বন, ব্রতকথা এসব নিয়ে শান্ত গ্রামীন জীবনযাত্রা।


অচেনা বুভুক্ষু দস্যুর আক্রমণে সে দিশাহারা হয়ে গেল। এর আগেও নানা পতন-অভ্যুদয়ের সে সাক্ষী। কিন্তু তা ছিল নিছক রাজার সাথে রাজার লড়াই- তার নিজের মান, শীল, কূল সেখানে অক্ষত থেকেছে। এই তুর্কি দস্যু দলে ন্যায় যুদ্ধের কোন ক্ষীনতম ধারণাও নেই।
বাঙালী দুর্ভাগ্যের ক্ষণকালীন বিরতি হয়েছিল এক তেজস্বী যুবার হাত ঘরে। আক্ষরিক অর্থে যিনি ধনী-দরিদ্র-ব্রাহ্মণ-শুদ্র নির্বিশেষে জনজাগরণ করেছেন সেই মহাপ্রভু বাঙালী রাজনীতির সবচেয়ে বড় আইকন। হুসেন শার সিংহাসন ও কেঁপে উঠেছিল সেই নিরস্ত্র বামুনের বাগ্মীতা আর কর্মে।
এ প্রসঙ্গে একটা পুরনো ঘটনা আবার নতুন করে মনে পড়ল। সে ঘটনা আমাকে চৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে ভাবতে প্ররোচিত করেছিল। সেটি পুরনো লেখা থেকে হুবুহু তুলে দিচ্ছি-
"আমার এতদিন একটা ভুল ধারনা ছিল যে, মুসলিমরা হিন্দু দেবদেবীর থানে মানত করেন না। কাটোয়ার শ্রীখন্ড গ্রামের নুরজাহান বিবি আমার ভুল ধারনা ভেঙে দিয়েছেন। নুরজাহান বিবির ক্যান্সার হয়েছে। নানা জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছেন। বলা বাহুল্য, চিকিৎসকদের বিধান পছন্দ না হওয়াই বিশ পঁচিশ বার ডাক্তার পালটেছেন। এখন তিনি বাবা ভূতনাথের থানে জোড়া পাঁঠা মানত করেছেন।
“আপনার মানতের কথা মোল্লারা জানতে পারলে যে আপনাকে একঘরে করবে”।
‘না বাবা, একঘরে করবে না। আমরা যুগ যুগ ধরে করে আসছি”।


“ভূতনাথ মানে আমাদের শিব- মাথায় জটা, গলায় সাপ, বাঘছাল আর গায়ে ছাই’।– আমি হাসি।
“হেসো না গো। আমাদের ঠাকুর খুব জাগ্রত”।
আমি আর হাসি না। শ্রীখণ্ডের লোক এরকম বলতেই পারে। এই গ্রামে শীনিবাসের বাড়ি। রঘুনন্দন, মুকুন্দদাস, নরোত্তম দাস আর নরহরি এই গ্রামের মানুষ। এই গ্রামেই না মহাপ্রভু স্বয়ং এসেছিলেন। এই গ্রামেই কৃষ্ণ মুরারি স্বহস্তে আধখানা নাড়ু খেয়েছিলেন। আমি নুরজাহানের কথাই মোটেই অবাক হচ্ছি না। হতে পারে, হতেই পারে। চৈতন্য পদচুম্বিত এই ভুমিতে সব কিছু সম্ভব।
এই আমাদের সত্যকার বাংলা, এই আমাদের ঐতিহ্য। যুগ যুগ ব্যাপী বিস্তৃত আমাদের সম্প্রীতির ইতিহাস। আমাদের শোণিতধারায় বয়ে চলেছে চৈতন্য মহাপ্রভুর বানী- যা হিংসা করতে শেখায় না, উচ্চ নীচের প্রভেদ করতে শেখায় না, সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধি ছাপিয়ে চিরন্তন মনুষ্যত্বের দীক্ষায় যা দীক্ষিত করে। "


যাক ধান ভানতে যথেচ্ছ শিবের গীত গাওয়া হয়েছে। আমাদের গুরুদেব বলেছিলেন-
"পশ্চিম-মহাদেশ তার পলিটিক্সের দ্বারা বৃহৎ পৃথিবীকে পর করে দিয়েছে, তার বিজ্ঞানের দ্বারা বৃহৎ পৃথিবীকে নিমন্ত্রণ করেছে। বৃহৎ কালের মধ্যে ইতিহাসের উদার রূপ যদি আমরা দেখতে পাই তা হলে দেখব, আত্মম্ভরি পলিটিক্সের দিকে য়ুরোপের আত্মাবমাননা, সেখানে তার অন্ধকার; বিজ্ঞানের দিকেই তার আলোক জ্বলেছে, সেখানেই তার যথার্থ আত্মপ্রকাশ; কেননা বিজ্ঞান সত্য, আর সত্যেই অমরতা দান করে।


বর্তমান যুগে বিজ্ঞানই য়ুরোপকে সার্থকতা দিয়েছে, কেননা বিজ্ঞান বিশ্বকে প্রকাশ করে; আর তার সর্বভুক ক্ষুধিত পলিটিক্স তার বিনাশকেই সৃষ্টি করেছে, কেননা পলিটিক্সের শোণিতরক্ত-উত্তেজনায় সে নিজেকে ছাড়া আর সমস্তকেই অস্পষ্ট ও ছোটো করে দেখে; সুতরাং সত্যকে খণ্ডিত করার দ্বারা অশান্তির চক্রবাত্যায় আত্মহত্যাকে আবর্তিত করে তোলে। আমরা অত্যন্ত ভুল করব যদি মনে করি, সীমাবিহীন অহমিকার দ্বারা জাত্যভিমানে আবিল ভেদবুদ্ধি দ্বারাই য়ুরোপ বড়ো হয়েছে। এমন অসম্ভব কথা আর হতে পারে না। বস্তুত সত্যের জোরেই তার জয়যাত্রা, রিপুর আকর্ষণেই তার অধঃপতন—সে রিপুর প্রবর্তনায় আমরা আপনাকে সব দিতে চাই, বাহিরকে বঞ্চিত করি।" পলিটিক্স দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায় কিনা জানি না, বাহুবল ও খুব স্বল্প সময়ের জন্য মানুষকে নিজের বসে রাখতে পারে কিন্তু তা মহাকালের হিসেবে ক্ষনস্থায়ী। আধুনিক রাজনীতির কারবারীরা বোঝেন নি- বিভাজন রাজনীতির সবচেয়ে নিকৃষ্ট পন্থা, ন্যায়ের পরিপন্থী ও মানবতার সবচেয়ে বড় বিপদ।


পাঁচ দশ হাজার বছর ধরেও যে আমরা টিকে আছি, মন্বন্তরেও মরি না, মারি নিয়ে ঘর করি তবু আনন্দ আছে, তবু জীবনে জীবন যোগ করতে চাই কারন আমাদের স্বাভাবিক ধর্ম-চেতনা। সেখানে আঘাত করলে হয়ত প্রত্যাঘাত করতে সময় লাগে, কারন আমরা এখন দুর্বল। কিন্তু সে ক্ষোভ আমাদের চেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করে, তুষের আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বলে। "প্রাচ্যসভ্যতার কলেবর ধর্ম। ধর্ম বলিতে রিলিজন নহে, সামাজিক কর্তব্যতন্ত্র; তাহার মধ্যে যথাযোগ্যভাবে রিলিজন পলিটিক্স সমস্তই আছে। তাহাকে আঘাত করিলে সমস্ত দেশ ব্যথিত হইয়া উঠে; কারণ সমাজেই তাহার মর্মস্থান, তাহার জীবনীশক্তির অন্য কোনো আশ্রয় নাই। শিথিল রাজশক্তি বিপুল চীনের সর্বত্র আপনাকে প্রবলভাবে প্রত্যক্ষগোচর করিতে পারে না।

রাজধানী হইতে সুদূরবর্তী দেশগুলিতে রাজার আজ্ঞা পৌঁছে, রাজপ্রতাপ পৌঁছে না; কিন্তু তথাপি সেখানে শান্তি আছে, শৃঙ্খলা আছে, সভ্যতা আছে। ডাক্তার ডিলন ইহাতে বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন। অল্পই বল ব্যয় করিয়া এত বড়ো রাজ্য সংযত রাখা সহজ কথা নহে।"(সমাজভেদ: রবীন্দ্র)।


অপরকে ছোট দেখানো, পুরনো সবকিছুকেই খারাপ দেখানো রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পারব? যদি আকস্মিক আইডেনডিটি বাদ দিয়ে কোন মৌলিক আইডেনডিটির জন্য রাজনীতি করতে হয়, তাহলে একমাত্র টেকসই রাজনীতি আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের বাঙালীয়ানা।

____________________________

ডা. রেজাউল করীম । বাংলা র প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক। সুপন্ডিত।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়