Ameen Qudir

Published:
2017-02-28 01:59:55 BdST

ডাক্তার নেই, ফি আছে! বিলের অঙ্কে গোঁজামিল


 

 সেই বেসরকারি হাসপাতাল। ইনসেটে মৃত আমির সোহেল

 

 



সোমা মুখোপাধ্যায়
___________________________

চিকিৎসক বাইরে। অথচ তাঁর নামে রোজ এক হাজার টাকার ভিজিটিং চার্জ! লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিল। এখানেই শেষ নয়। রোগীর পরিবার হাসপাতালের বিলে সেই গোঁজামিল ধরে ফেলতেই বকেয়া টাকা এক নিমেষে মকুব। রোগীর মৃত্যুর পরে হাসপাতাল থেকে বলা হয়, টাকা মেটানোর দরকার নেই। দ্রুত মৃতদেহ নিয়ে যান। শুধু বিলটা হাসপাতালেই থাকবে।

রোগীর আত্মীয়রা বলছেন, নিজেদের গাফিলতি ঢাকতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেহ ছেড়ে দেন টাকা না নিয়ে। বিলের গরমিল নিয়ে রোগীর পরিবার গোলমাল করতে পারে —এমন আশঙ্কায় পুলিশকেও আগাম জানিয়ে রাখেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরিজনদের দাবি, দেহ হাতে পাওয়ার আগে তাঁদের পাঠানো হয় থানায়। শনিবার মধ্যরাতের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে তমলুকের বাসিন্দা আমির সোহেলের পরিবারের।

বেসরকারি হাসপাতালে অনিয়ম খুঁজে পেলে তা বরদাস্ত করা হবে না বলে গত বুধবার হাসপাতাল কর্তাদের ডেকে হুঁশিয়ারি দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনিয়মের সেই তালিকায় নয়া সংযোজন মল্লিকবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতাল।

 

শনিবার রাত সাড়ে তিনটে। মল্লিকবাজারের ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেসের সামনে গাড়ি থেকে নামে দশ-বারো জন যুবক। তখনই পুলিশের জিপ এগিয়ে আসে। আমিরের এক আত্মীয় বলেন, ‘‘এক জন পুলিশকর্মী নেমে বললেন, থানায় চলুন।’’ ওই আত্মীয়ের দাবি অনুযায়ী থানায় কেন যেতে হবে জানতে চাইলে ‘মোলায়েম ভাবে’ বলা হয়, ‘‘থানায় গিয়ে বসবেন। সকালে ডেড বডি নিয়ে চলে যাবেন। বুঝতেই পারছেন। অ্যাক্সিডেন্ট কেস তো!’’ আর এক আত্মীয়ের বক্তব্য, ‘‘আমরা বললাম, জানি। সে জন্যে এখন থানায় যেতে হবে কেন? বাড়ির লোক মারা গিয়েছেন। আগে তো হাসপাতালে ঢুকব! তত ক্ষণে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছেন কয়েক জন কর্মী। তাঁরাও নাছোড়বান্দা। ‘থানাতেই যান, এখানে ঢুকে লাভ নেই।’ কী করব বুঝতেই পারছিলাম না।’’

 

তমলুকের বাসিন্দা বাইশ বছরের শেখ আমির সোহেল গত ৩০ জানুয়ারি থেকে এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ২৯ তারিখ রাতে বাইক দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। মাথায় গুরুতর চোট লাগে। প্রথমে তমলুক হাসপাতাল, সেখান থেকে এসএসকেএম। এসএসকেএম-এর ডাক্তাররা দেখে জানান, অবস্থা গুরুতর। অস্ত্রোপচার দরকার। কিন্তু সে ধকল নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। অবিলম্বে ভেন্টিলেশনে দিতে হবে। এসএসকেএম-এর আইটিইউ-এ শয্যা ছিল না। তাই দ্রুত স্থানান্তরিত করতে বলেন ডাক্তাররা। সোহেলকে আনা হয় মল্লিকবাজারের ওই বেসরকারি হাসপাতালে। তাঁর বাবা হাবিবুল হোসেন জানান, ‘‘এসএসকেএম অস্ত্রোপচারের মতো অবস্থা নেই জানালেও এখানে শুরুতেই বলা হয়, ‘এখনই এক লাখ টাকা জমা দিন, অস্ত্রোপচার হবে’। প্রতি দিন ৩০–৩৫ হাজার টাকার মতো খরচ হবে।’’

 

পরিবারের বক্তব্য, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অবস্থার অবনতি শুরু হয় সোহেলের। হাবিবুল বলেন, বিল চার লক্ষ অতিক্রম করতেই তাঁরা সরকারি হাসপাতালে শয্যা খুঁজতে শুরু করেন। সোহেলের দাদা মনজুর রহমান বলেন, ‘‘কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানান, ‘ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। পুরসভার চিঠি নিয়ে আসুন। কিছু ছাড়ের ব্যবস্থা করব।’ তখন মেয়রের চিঠি নিয়ে যাই।’’

আমিরের আত্মীয়ের অভিযোগ, শনিবার বিকেলে ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকার বিল মেটান তাঁরা। তার পরে রাত ন’টায় জানানো হয়, পৌনে ন’টায় মারা গিয়েছেন সোহেল। বকেয়া বিল দ্রুত মিটিয়ে মৃতদেহ নিয়ে যান। পরে অবশ্য সেটা না নিয়েই ছেড়ে দেওয়া হয় দেহ।

এগারোটা নাগাদ মৃতের বাড়ির কয়েক জন হাসপাতালে পৌঁছে জানতে পারেন, বাকি রয়েছে ২ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা। মনজুর জানান, তখন তিরিশ হাজারের বেশি ছিল না। বিল দেখতে চান ওঁরা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘বিল খুলেই তাজ্জব হয়ে যাই। যে ডাক্তার টানা বেশ কয়েক দিন কলকাতায় ছিলেন না বলে নিজেই জানিয়েছিলেন, তাঁর নামে রোজ এক হাজার টাকা করে ফি নেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে চিৎকার শুরু করি। বলি, তমলুক থেকে লোকজন আসছে। এর জবাব চাই।’’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একাংশের দাবি, রোগীর পরিবারের হুমকির মুখে তাঁরা পুলিশকে সব জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। সিএমআরআইয়ের মতো ফের ভাঙচুর এড়াতেই আগাম পুলিশ ডাকা হয়। যদিও থানায় যাওয়ার পরেই মৃতদেহ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পরিবার। সব ‘ফর্মালিটি’ মিটিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোতে রবিবার বিকেল তিনটে হয়ে যায়। তাঁরা জানিয়েছেন, সুবিচার চাইতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হবেন।

কেন টাকা মকুব করা হল? কর্তৃপক্ষের জবাব, ‘‘ওঁরা গরিব। টাকা দিতে পারছিলেন না।’’ যাঁরা দিতে পারেন না, তাঁদের সবারই কি টাকা মকুব হয়? উত্তর মেলেনি। বিল কেন দিলেন না? যে ডাক্তার শহরে নেই তাঁর নামে ফি নেওয়ার অভিযোগই বা কত দূর সত্য? ফিনান্স অফিসার পল্লব চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কিছু বলতে পারব না।’’ তা হলে কে বলবেন? তিনি জানান, ‘‘সোমবারের আগে কেউ কথা বলতে পারবেন না।’’

____________________________

সোমা মুখোপাধ্যায় । কলকাতা। বাংলার প্রখ্যাত সাংবাদিক।

সৌজন্যে আনন্দবাজার পত্রিকা।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়