Ameen Qudir

Published:
2017-01-25 22:10:06 BdST

হাসপাতালে বিজি প্রেসের টিকেট: চিকিৎসা নিয়ে প্রহসনের শুরু


 

ডা. রাজীব দে সরকার
___________________________

৩ টাকায় প্রেসক্রিপশন, ৩ টাকায় ডাক্তার!!
কিংবা ৩ টাকার প্রেসক্রিপশন, ৩ টাকার ডাক্তার!!!

যেভাবেই বলি না কেন, বাস্তবতা এর থেকেও সস্তা। সস্তা, সেবা গ্রহীতা জনসাধারণের কাছেই। হাসপাতালে রোগী দেখাতে এলেই ছোট্ট একটা চিরকুট দেওয়া হয়। কোথাও ৩ টাকা, কোথাও ৫ টাকা, কোথাও বা ফ্রী। এই চিরকুটে ঐশ্বর্য্যময় যতো কথাই লেখা থাকুক না কেন, তা প্রেসক্রিপশনের মর্যাদা পায় কি? আদৌ এর মর্যাদা বা মূল্য, কিংবা মূল্যাবান কতোটুকু?

চেম্বারে তো আমরা ঠিকই নাম ছাপানো, ডিগ্রী লেখা, উপদেশ লেখা, দৃষ্টিনন্দন প্যাডের কাগজে চিকিৎসাসেবার কে মুখোরোচক করে উপস্থাপন করি। মুখোরোচক কেন লিখলাম? দারুন রান্নাও যদি আগের দিন না ধোয়া প্লেটে দেওয়া যায় খেতে কতোটুকুই বা রুচি হবে? সেবাকে সেবার মতো করেই উপস্থাপন করা উচিৎ। কিন্তু সরকারী হাসপাতালে আসা মানুষের জন্য এই বিরূপ আচরণ কেন? ৩ টাকা দিয়ে দিয়ে যদি একটি চিরকুট আপনি রোগী বা তার স্বজনের হাতে ধরিয়ে দেন, তবে তাকে "প্রেসক্রিপশন" মনে করে মর্যাদা পাওয়াটা, একটু "অতি আশা" করা হয়ে গেলো না?


৩ টাকার ঐ টিকেটেই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক (যিনি প্রজাতন্ত্রের গেজেটেড একজন সম্মানিত বিসিএস কর্মকর্তা) রোগীর রোগের লক্ষণ, রোগের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য ইতিহাস, পরীক্ষা নিরীক্ষা কিংবা তাদের ফলাফল, এবং সর্বোপরি রোগীর ঔষধের নাম ও উপদেশ লিখে থাকেন। একজন অফিসার এর লেখার জন্য কাগজটি কতোটুকুই বা সঠিক?

আমরা জানি, একটি আদর্শ প্রেসক্রিপশন এর অনেক গুলো অংশ থাকে (সুপারইন্সক্রিপশন, ইন্সক্রিপশন, সাবস্ক্রিপশন, সিগনেচার ইত্যাদি)। যেগুলোর কোন অংশই বাদ দেওয়া যায় না। অথচ আমাদের সরকারী হাসপাতাল এই টিকেট নামে চিকিৎসা চিরকুটে 'পদ্মপাতায় মহাসাগর আঁটানো'র মতো করে লিখতে হয়!

নাহয় লিখছি, লিখলাম...
কিন্তু রোগী কী পেলেন? পেলেন ৩ টাকা দিয়ে '৩ টাকার একটি কাগজ'। ছোট্ট ঐ চিরকুটে কী লেখা রইলো বা কাগজটির ভবিষ্যৎ কোন ব্যবহার আছে কী না তা নিয়ে রোগীর কোন চিন্তা আছে বলে আমি মনে করি না। কারন এতো ছোট কাগজে আর কী বা দামী কথা লেখা থাকতে পারে।

তাই চিকিৎসা করেও গালির ভাগিদার আমরা থেকে যাই। এরপর রোগী যখন প্রয়োজনের থেকে ২/১ টা ঔষধ কম পান, তখন ডাক্তারদের দু/চার কথা না শুনিয়ে তারা হাসপাতাল ত্যাগ করাটাকে একটা অগণতান্ত্রিক আচরণ মনে করেন।

"কী কাগজ দিলেন ডাক্তার বাই। ওষুদ পালাম না"
"কী যে নিকে দিলেন। ওষুদ দেলো না"

অথচ একজন চিকিৎসকের পরিশ্রম এর পরেও কেন রোগী তৃপ্ত হলেন না?
কেন তিনি মনে করলেন সরকারী হাসপাতালে এসে তার কোন লাভই হয়নি?
কারনঃ চিরকুট, বিজি প্রেস থেকে ছাপা হওয়া ছোট্ট ঐ টিকেটটি।

অথচ এমন হবার কথা ছিলো না।
রোগী আসবেন। কাউন্টারে রেজিস্ট্রেশন করবেন। একটি সিরিয়াল কোড পাবেন। সেই কোড অনুযায়ী তিনি নির্দিষ্ট রুমে যাবেন।
একজন চিকিৎসক যতো কম সময়ই দিন না কেন, তিনি A4 সাইজের একটি ৮০ গ্রাম অফসেট কাগজে তার নাম, পদবী, ডিগ্রীসহ উল্লেখ সহ চিকিৎসা পত্র দিবেন। রোগী ৩ টাকা দিয়ে ঔষধ না পেলেও একটি সম্মান দেবার মতো চিকিৎসা পত্র যেন হাতে পান। রোগী জানবেন চিকিৎসক তাকে দেখেছেন এবং যা দেখেছেন তা এই সুন্দর কাগজটিতে লেখা আছে। এই কাগজে ফেলে দেওয়া চলবে না, হারানো চলবে না। রেখে দিতে হবে।

আমার হাসপাতালের বাইরে দেখেছি অনেক অনেক টিকেট মাটিতে পড়ে থাকতে। কেন পড়ে থাকে এগুলো? কেন মানুষ এগুলোকে ফেলে রেখে চলে যায়? আমরা কয়জন চিকিৎসক পরবর্তী ফলো-আপে দেখেছি রোগী আগের বারের চিরকুট নিয়ে এসেছেন? যাদের জন্য এই আয়োজন, তাদের ঘরে আমাদের লেখা একটা কাগজ যদি সসম্মানে ঢুকতে না পারে তবে আমার পরিশ্রমের মূল্য কোথায়?

রোগী কষ্ট করে হাসপাতালে আসেন। একজন চিকিৎসকও অনেক শ্রম ও মেধার সাহায্যেই রোগীকে সময় দেন। আমি মনে করি, টিকেট নামে যে বস্তুটি আমাদের হেলথ সিস্টেমে আছে তা সেবাদানকারী ও সেবাগ্রহীতা উভয়ের জন্যই একটি অসম্মান এর বস্তু।

রোগের দলিল হবার কথা ছিলো যে মূল্যবান কাগজটির, তা হাসপাতালের মাঠে পড়ে থাকলো কেন তা ভাবার সময় এসেছে।
___________________________

 

 

ডা. রাজীব দে সরকার
বিশেষ কর্মকর্তা
কো-অর্ডিনেশন ও মিডিয়া মনিটরিং সেল,
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়