Ameen Qudir

Published:
2016-12-21 02:43:48 BdST

ডিগ্রির মুলো ঝুলিয়ে অনারারী কামলা ডাক্তার দিয়েই চলছে স্বাস্থ্য সেক্টর



প্রতিকী ছবি।

 

 

___________________________

ডা. মুহসিন আবদুল্লাহ
 ____________________


হাসপাতালের ক্যান্টিনে ঢুকতেই আমার চোখ গেল কর্নারের টেবিলে। একা বসে আছেন ডাঃ বকুল। খুবই শান্ত শিষ্ট নিরীহ মানুষ। তবে আজ মনে হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি গম্ভীর। বেশ বিমর্ষ চেহারা।
গিয়ে বসলাম পাশে।

-কী ব্যাপার বকুল ভাই, মন খারাপ?
-জ্বি ভাই। আজকে একজনের সাথে একটু রুড আচরণ করে ফেলেছি। এখন মনটা খারাপ লাগছে। লোকটা ডাক্তারদের ব্যাপারে নিশ্চয় একটা খারাপ ধারণা নিয়ে গেলো। মানুষ কষ্ট নিয়েই হাসপাতালে আসে, কিন্ত ভাই সবসময় মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। রাখতে পারি না। আর যারা এক লাইন বেশি বোঝে তাদের আমি কেন যেন সহ্য করতে পারি না।

ডাঃ বকুল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনারারী মেডিকেল অফিসার। সোজা বাংলায় ইনি একজন ডাক্তার যিনি তার শ্রমের বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক পান না। ডাক্তার হয়েছেন বছর খানেক আগেই। একটা ক্লিনিকে চাকরি করেন। একদিন তাঁর মনে হলো, শুধু ক্লিনিকের চাকরি করে দিনকে দিন মেডিকেল নলেজের ধার কমে আসছে। ট্রেনিং করা দরকার। আবারো পড়ালেখায় নামা দরকার। তাছাড়া ভবিষ্যতের বাজারে টিকে থাকার জন্য একটা পোস্ট গ্রাজুয়েশান ডিগ্রীও করা দরকার।

অতঃপর সিনিয়র ভাইদের পরামর্শে ডাঃ বকুল ঢুকে পড়লেন অনারারী ট্রেনিং এ। হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের অদ্ভুত হেলথ সিস্টেমের এক কিম্ভুত সদস্য, একজন বিনে পয়সার কামলা।

গতকাল রাতে তাকে ক্লিনিকে ডিউটি করতে হয়েছে। রাতটা বেশ 'খারাপ'ই গেছে বলতে গেলে। ক্রিটিকাল পেশেন্ট ছিল, ডেথ ডিক্লেয়ার করতে হয়েছে দু'জনের। ঘুমানোর কোন সুযোগই হয়নি। সকালে উঠে আবার ট্রেনিং-এর নামে বিনেপয়সার কামলাগিরি করতে এসেছেন।

সকালে এমনিতেই কাজের চাপ বেশি থাকে। নতুন ভর্তি রোগীর হিস্ট্রি রিভিউ, ফলো আপ, ইনভেস্টিগেশান প্ল্যান, ট্রিটমেন্ট রিভিউ, পুরনো রোগীদের ফলো আপ, ট্রিটমেন্ট এডজাস্ট করা, ছুটি দেয়া, রাউন্ড, ক্লাস, সেমিনার ইত্যাকার নানা কাজ। দম ফেলা মুশকিল।

এরই মধ্যে যখন এক পেশেন্টের এটেন্ড্যান্ট বিরুপ মন্তব্য করে বসলো তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন নি। কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন । তারপর থেকে বেচারার নিজেরই মন খারাপ।

আমারও খারাপ লাগলো। ডাঃ বকুল এবং সেই এটেন্ড্যান্ট উভয়ের জন্যই খারাপ লাগলো। কিন্তু আমি কোনভাবেই ডাঃ বকুলকে দোষ দিতে পারলাম না। আমি জানি, ডাঃ বকুল অকারণে মেজাজ খারাপ করার লোক নন। আসলে ডাঃ বকুল এমন এক অমানবিক সিস্টেমের শিকার, যে সিস্টেম তার মত নিরীহ মানুষকেও আজ রুঢ় করেছে। যে সিস্টেম তার যৌবনের সোনালি সময়কে সিস্টেমের মারপ্যাচে ফেলে অপব্যবহার করে যাচ্ছে। এর কিছুটা বিরুপ প্রভাব অন্যদের ওপরও পড়বেই, এখন আর এতে খুব একটা অবাক হই না।

আমি জানি, ডাঃ বকুলকে যদি আলাদাভাবে ক্লিনিক ডিউটি করতে না হত, তাকে যদি পেটের চিন্তায় মগ্ন থাকতে না হত, তার কর্মঘন্টা যদি নির্দিষ্ট থাকতো এবং ওয়েল পেইড হত, তাহলে তিনি কখনোই মেজাজের খেই হারাতেন না।

You haven't given him a sound sleep, how can he give you a good smile??

২।
এই অংশটুকু বিশেষত নন-মেডিকেল পাঠকদের উদ্দেশ্যে। আপনার মনে যে প্রশ্নটি চলে এসেছে তাহলো- ট্রেনিং তো ডাক্তাররা করছেন তার নিজের জন্য, নিজের ডিগ্রীর জন্য। এর জন্য সরকার ভাতা দেবে কেন? এত কথা কেন?

এই প্রশ্ন যদি সত্যিই আপনার মনে এসে থাকে তাহলে সেটা বড়ই আফসোসের কথা। পর্যাপ্ত ডাক্তার নিয়োগ দেয়া এবং ডাক্তারদের ভাতা দিয়ে ভালো করে ট্রেনিং করানোর দাবি আপনাদের পক্ষ থেকেই তোলা উচিত। কারণ, ডাক্তার দক্ষ না হলে এর কুফলটা আপনাকেই ভোগ করতে হবে। সরকারি হাসপাতাল বলেন আর বেসরকারি বলেন, কোথাও পর্যাপ্ত ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়না। ফলে অল্প ক'জন ডাক্তারকে অতিরিক্ত চাপ নিতে হয়। ডাক্তার নাহয় শায়েস্তা হলো, কিন্তু আপনি কি পূর্ণ মনোযোগ পান? না পেলে আপনি কী করেন? ডাক্তারকে গালিগালাজ করেন? নাকি ডাক্তারের নামে অভিযোগ করেন? কখনো কি কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেছেন- এতজন রোগীর জন্য একজন ডাক্তার কেন? কখনো কি দাবি তুলেছেন- এত টাকা বিল দিলাম, ডাক্তারের বেতন এত কম কেন? নাহ। তা করেন নি।

ডাক্তারদের ভালো ট্রেনিং এর ব্যবস্থা আপনাদের নিজেদের স্বার্থেই করতে হবে। বিকজ, দে ডিলস উইথ ইওর লাইফ এন্ড ডেথ। তাদের আপডেটেড নলেজ এন্ড স্কিল না থাকলে দিনশেষে আপনিই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপনার বাবা মা, আপনার সন্তান। হয়তো ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে ভাংচুর করবেন, হয়তো পত্রিকায় নিউজ হবেন। কিন্তু যদি কোন ক্ষতি হয়েই যায়, তা কি ফিরে পাবেন?

ডাক্তারদের পেটের চিন্তা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বিকজ, দে হ্যাভ টু লিভ দা মোস্ট স্ট্রেসফুল লাইফ। পেট এবং মাথা দুই জায়গায় চাপ নিয়ে ভালো সেবা দেয়া যায় না। আর এ কারণেই উন্নত বিশ্বে ডক্টরস আর অলওয়েজ হাইলি পেইড। আমার দেশে একটা সরকারী হাসপাতালের একটা ওয়ার্ড চালানোর জন্য যতজন ডাক্তার দরকার, আমার সরকার নিয়োগ দিয়েছে তার এক চতুর্থ বা পঞ্চমাংশ। আর সেই জায়গা পুরণের জন্যই জিইয়ে রাখা হচ্ছে এই অমানবিক সিস্টেম। ডিগ্রীর মুলো ঝুলিয়ে বিনেপয়সায় খাটিয়ে শোষণ করা হচ্ছে তরুণ ডাক্তারদের সোনালি সময়। একটা দিনও যদি এই ডাক্তাররা কাজ না করেন, তাহলেই হাসপাতাল অচল হয়ে পড়বে।

আপনি এই সিস্টেমকে সমর্থন করেন? যদি করেন, তাহলে আপনি ভালো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আপনি যদি এই সিস্টেম পরিবর্তনের দাবি না তোলেন, তাহলে আপনি আন্তরিক চিকিৎসা পাবার আশা করতে পারেন না।

আপনি ঘোড়াকে ক্রমাগত চাবুক মারবেন, সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপাবেন, আর বিনিময়ে সে আপনাকে মুচকি হাসি দিবে, তা হয় না।

________________________________

 

 

লেখক
ডা. মুহসিন আবদুল্লাহ মু। লোকসেবী চিকিৎসক। কলামিস্ট। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়