Ameen Qudir

Published:
2018-09-09 19:30:20 BdST

যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে ১৫০০০ টাকা মাইনে : ১ বছরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সার্টিফিকেট বন্ধক : এই তো ডাক্তার !!


লেখকের ছবি


ডা.জামান অ্যালেক্স
________________________________________
যখন লিখছিলাম;তার
আর ক'দিন পরই ঈদ উল আযহা। চারদিকে আনন্দমুখর পরিবেশ। তবে এই আনন্দমুখর পরিবেশ কিছু চিকিৎসককে স্পর্শ করছে না। তারা যে রুমটাতে বসে আছেন সেই রুমটাতে পিনপতন নিরবতা। এইমাত্র খবর এসেছে এইবার থেকে ঈদে তারা আর বোনাস পাচ্ছেন না....

দুঃখভারাক্রান্ত মনে তারা আস্তে আস্তে এক একজন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এছাড়া অবশ্য তাদের আর করার কিছুই ছিলো না, প্রতিবাদ করামাত্র তাদের চাকরীটা চলে যাবে, হসপিটাল ম্যানেজম্যান্ট তাদের বেতনের চেয়ে আরো কম টাকায় চিকিৎসক রিক্রুট করার জন্য বসে আছে....

এক চিকিৎসক অবশ্য একটু সাহস দেখিয়েছিলেন, বোনাস না দেয়াতে এডমিন ম্যানেজারকে দুটো কথা শুনিয়েছিলেন।এই চাকরীটা চলে গেলে তার কি অবস্থা হবে সেটা চিন্তা করে প্রমাদ গুণলেন। কিভাবে প্রায়শ্চিত্ত করা যায় সেটা কিছুক্ষণ চিন্তা করে ১ লিটারের একটা ঠান্ডা কোক কিনে এডমিন ম্যানেজারের রুমে পাঠিয়ে দিলেন....

২....

এলাকার একটা ছোটখাটো ফার্মেসী কাম চেম্বার। সন্ধার পর ৭-৯ টা এবং ৯-১০ঃ৩০ টা পর্যন্ত পালা করে দুজন চিকিৎসক বসেন। ৯ টায় যে চিকিৎসক বসেন তিনি একদিন আসতে পারলেন না। ৩ জন রোগী ওয়েট করে চলে গিয়েছিলো। পরদিন তিনি চেম্বারে আসলে অর্ধশিক্ষিত ফার্মেসী মালিক কয়েকটা কটু কথা শোনালো। কথাগুলো গায়ে লাগাতে চিকিৎসক রাগ করে কয়েকদিন চেম্বারে আসা বাদ দিলেন। এলাকার ছোট ঐ চেম্বারে বসার জন্য ৪ জন ডাক্তারের মাঝে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। Unbelievable? Believe it....

ঐ চিকিৎসককে তার পরবর্তী কয়েকদিন চেম্বারের সামনের বেঞ্চিতে ঐ ফার্মেসীর মালিকের সামনে বসে থাকতে দেখেছিলাম। যে চেয়ারটায় বসে আগে তিনি রোগী দেখতেন, ঐ একই চেয়ারে বসে এখন নতুন একজন চিকিৎসক রোগী দেখেন.....

৩....

ঢাকার ভেতরে একটি হাসপাতাল।সদ্য পাশ করা এক তরুণ চিকিৎসক ঐ হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তার হিসেবে কাজ শুরু করলেন, মাইনে ১৫০০০ টাকায়। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো এই জবটি পেতে ঐ চিকিৎসককে তার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সার্টিফিকেট বন্ধক রাখতে হয়েছে, ১ বছর চাকরী পূর্ণ হলেই সার্টিফিকেটগুলো ফেরত দেয়া হবে....

ঘটনাক্রমে ঐ চিকিৎসকের মা আমার পূর্বপরিচিত, তিনি চোখের পানি ফেলে বিষয়টি আমার সাথে শেয়ার করেছিলেন। আর যাই হোক সার্টিফিকেটগুলো আটকে রাখা আমি মানতে পারি নাই, একজন আদর্শ চিকিৎসক কত কষ্ট করে চিকিৎসক হয়-সেটা আমার জানা আছে, টাকার বিনিময়ে সে সার্টিফিকেট আটকে রাখার ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয় নাই। আমি ঐ চিকিৎসকের মা'কে একবার বললাম, 'চলেন, দেখি কে আপনার ছেলের সার্টিফিকেট আটকে রাখলো'। উনি রাজী হন নাই, সার্টিফিকেট আটক হলেও বেকার ছেলের তকমাটা তো আর নেই....

যদিও বিষয়টা নীতিগতভাবে মিল খায় না, তারপরও বলি--আমার ড্রাইভারের মাসিক বেতন ১৬০০০ টাকা। চিন্তা করেন তো, দেশে চিকিৎসকদের অবস্থা কতটা করুণ হলে একজন চিকিৎসক তার সার্টিফিকেট জমা দিয়ে ১৫০০০ টাকা মাসিক বেতনে রাজী হয়!!!....

৪...

"সাঁঝের মায়ায় আঁধার কাটি
গোধূলির লাল রক্ত
জমিয়ে রাখা গল্পগুলো
করেছি সব মুক্ত..."

গল্প বাদ থাকুক, কয়েকটা ড্যাটা দেই...

২০১৬ সালে দেশে প্রয়োজনের তুলনায় সাড়ে এগারো হাজার চিকিৎসক অতিরিক্ত ছিলো। আর ৩ বছর পর ২০২১ সালে অতিরিক্ত এই চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে তিপ্পান্ন হাজারে, ২০২৬ সালে সেটা প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজারে গিয়ে ঠেকবে। BIDS এর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী এসব চিকিৎসক একসময় স্বাস্থ্য খাতের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে....

দেশের বাইরে নতুন কোন job opportunity তৈরি হয়েছে বলে আমার জানা নেই, ২০১০, ২০১১,২০১২ এবং ২০১৩ সালে দেশের বাইরে যথাক্রমে ৬৮, ২৯,২২ ও ১২ জন চিকিৎসক চাকরীর সুযোগ পেয়েছিলেন (তথ্যসূত্রঃ সমকাল)....

এই যদি হয় সিনারিও তবে একবার কল্পনা করুন চিকিৎসকদের সামনে আরো কত ভয়ঙ্কর বিপর্যয় অপেক্ষা করছে...

কয়েকদিন আগে চিকিৎসক হিসেবে কেন আমাদের ফ্রাস্টেইটেড হওয়া উচিত নয়-সেটা নিয়ে আরেক চিকিৎসককে পয়েন্টওয়াইজ বেশ ইনস্পায়ারিং একটা লেখা লিখতে দেখলাম। সবাই বেশ প্রশংসা করলেন। যারা প্রশংসা করেছেন তাদেরকে বিনীতভাবে উপরের ঘটনাগুলো ও ড্যাটাগুলো গভীরভাবে অ্যানালাইসিস করার অনুরোধ করছি। আমরা অবশ্য বাস্তবতা ও ড্যাটা বাদ দিয়ে চারপাশে মোটিভেশন খুঁজি, Salt কে Sugar ভেবে ভুল করি। তবে অন্ধ হলেও প্রলয় কিন্তু বন্ধ থাকে না...

৫....

একটা ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। কিভাবে আমি একটি পরিবারের কাছে হিরো থেকে জিরো হলাম সেটা বলি। বাঙালি কতটা আবেগপ্রবণ তারও একটা আইডিয়া পাবেন...

পরিচিত এক আঙ্কেল ও তার পরিবারের কাছে আমি আইডল। আঙ্কেলের মেয়ে গতবার মেডিকেলে চান্স পায় নাই, চান্স পাওয়ার ধারে কাছেও ছিলো না। এবার আঙ্কেল ডিটারমাইন্ড যে এবারো কোথাও না হলে প্রাইভেটে পড়িয়েই মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। আঙ্কেল একদিন তার মেয়েকে আমার কাছে পাঠালেন যাতে মেয়েটিকে এ ব্যাপারে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত করি...

এ দেশের মেডিকেল সেক্টরের ভেতরের অবস্থা আমার জানা আছে।প্রতিষ্ঠিত সরকারী মেডিকেলেই শিক্ষক সংকটে ENT এর চিকিৎসককে Pharmacology, Psychiatry এর চিকিৎসককে Anatomy পড়াতে দেখেছি, যেগুলো নতুন-সেগুলোর কথা বাদই দিলাম।বেসরকারী এক মেডিকেল তখন তার সদ্য পাশ করা চিকিৎসককে নিয়ে মনোপলি খেলছে, নতুন করে এক লাখ আশি হাজার টাকা দেয়া ছাড়া ইর্ন্টানী পর্যন্ত শুরু করতে দিচ্ছে না। শত শত চিকিৎসক বেকার। এমন অবস্থায় কিভাবে একটা অ্যাভারেজ মেধার মেয়েকে আমি ভুল পথ দেখাই?

আমি মেয়েটিকে মেডিকেলে ভর্তি হতে নিরুৎসাহিত করলাম।ফলাফল ভালো হয় নাই, আঙ্কেল এখন আমাকে দেখেও দেখেন না, কথাটা পর্যন্ত বলেন না। বাঙালির ভালো করলে এরা অবশ্য খারাপ বুঝে....

৬...

কথাবার্তা সহজসরল করি। প্রতিটা লেখার কিছু রেকমেন্ডেশন থাকে। এই লেখার রেকমেন্ডেশনগুলো বলিঃ

--দয়া করে আপনার আশেপাশে ছেলেমেয়েগুলোকে চিকিৎসক হতে আর উৎসাহ দিবেন না। এরা যেন পলিটিক্যাল স্ট্যান্টবাজিতে নির্মিত নিম্নশ্রেণীর সরকারী মেডিকেল কলেজ ও মনোপলি খেলা মানহীন বেসরকারী মেডিকেল কলেজের খেলার বস্তু না হয়। জব মার্কেটের অবস্থাটা এদের পিতামাতার সামনে তুলে ধরুন...

-- "The art of Knowing is Knowing what to ignore..." আমাদের হর্তাকর্তাদের আবার দয়ার শরীর, তারা সহজে কাউকে না করতে পারেন না, ইগনোর করতে পারেন না, ফলশ্রুতিতে একটার পর একটা মানহীন সরকারী ও বেসরকারী মেডিকেল কলেজ। মানহীন সরকারী ও বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ করা হোক, তবে আপগ্রেড করে এগুলো হাসপাতাল হিসেবে চলতে পারে...

--যে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক এদেশে আছে এদের সবার মানসম্মত চাকরী নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এদের জন্য দ্রুত ভিত্তিতে দেশের বাইরে চাকরীর বাজার তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে হবে...

৭....

একটা সময় এদেশে চিকিৎসকেরা নির্ভাবনায় জীবনযাপন করতেন। তাদের ধ্যান জ্ঞান জুড়ে থাকতেন শুধুমাত্র রোগীরা। রোগীর প্রতি তাদের ডেডিকেশন ছিলো, পেশেন্টকেয়ার ছিলো তাই তখন মানসম্পন্ন....

যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে একটার পর একটা অপরিপক্ক খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে এখন সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।চিকিৎসককে আজ তার চাকরী নিশ্চিত করতে অর্ধশিক্ষিত ম্যানেজারকে তোয়াজ করতে হয়, সার্টিফিকেট বন্ধক রাখতে হয়, চেম্বার বাঁচিয়ে রাখতে মূর্খকে সমঝে চলতে হয়....

মেডিকেল সায়েন্সের মত এক্সট্রিম স্কিলড্ প্রফেশনে যখন চিকিৎসকের ধ্যান জ্ঞান জুড়ে থাকার কথা তার পেশেন্টের কন্ডিশন, সে সময়টায় তার মস্তিষ্কে অনুরণিত হয় তার জীবনে প্রতারিত হওয়ার বেদনাগুলো। এগুলো কি তাদের প্রাপ্য ছিলো?এভাবে কি এদেশের মানুষগুলোর কোয়ালিফায়েড সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব? আমরা কি আশা করতে পারি যে এক সময় এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে? সেই পরিবর্তন নিয়ে আসতে আমাদের আর কতটা পথ হাঁটতে হবে?....
___________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স । সুলেখক। লোকসেবী চিকিৎসক।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়