Ameen Qudir

Published:
2018-06-03 17:54:25 BdST

বৃক্ষমানব আবুল বাজনদার এতো পেলেন; তারপরও পালিয়ে গেলেন অকৃতজ্ঞের মত


ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠার পর বৃক্ষমানব আবুল বাজনদার। ফাইল ছবি।



সৈয়দ শাওন

_______________________

আবুল বাজনদার কাউকে কিছু না বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট ছেড়ে গেছেন চিকিৎসায় অবহেলা এবং নার্সদের ব্যবহার খারাপ বলে!

আবুল বাজনদার বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন, সরকারী খরচে তার সর্বোচ্চ চিকিৎসা চলছিলো, চিকিৎসার বাইরেও তাকে জমি কিনে দেয়া হয়েছে, তারপরও তিনি হতাশা আর ক্ষোভ নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন চোরের মত...।
এই আবুল বাজনদার হচ্ছেন আমাদের বেইমান অকৃতজ্ঞ জাতিসত্তার প্রতীক।


সম্প্রতি আমার ওয়ার্ডে ফর্নিয়ার্স গ্যাংগ্রিন এর এক রোগীর লোক হতাশা ব্যক্ত করে বললেন তারা এখানকার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট না, এখন কি করা যেতে পারে তার পরামর্শ চাইলেন, আমি বললাম দেখুন যে রোগটি হয়েছে ঠিক মাথা বা পেটব্যথা রকমের নয় যে ওষুধ খেলাম, সেরে যাবে, আপনার রোগীর অপারেশনের প্রস্তুতি চলছে, ধৈর্য্য ধরতে হবে, এবং তাও যদি আপনারা মনে করেন আপনাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমরা আরো উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে ঢাকায় রেফার করে দিতে পারি। আমাদের এটুকু করার আছে, তবে এটাও বলে দিচ্ছি যে ঢাকায় গিয়েই রোগী রাতারাতি সেরে যাবে তেমনটি নয়।
এটা শুনে রোগীর ছেলে নিজের অবস্হান থেকে পিছিয়ে গেলেন, আমাদের ই যা করার করতে বললেন কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব, আমি শুধু হেসে বললাম, এই ওয়ার্ডে রোগী ৫০ জন, সবাই দ্রুত হয়ে বাড়ি যেতে চায়, আমরাও তাই চাই, কিন্তু আপনি যেমন কেবল আপনার রোগীর কথা ভাবেন, আমাদের ভাবতে হয় এই ৫০ জনের কথাই, এখন বলেন দায়িত্বটা কার বেশী,
আপনার না আমাদের?

আমাদের প্রফেসররা সবসময় বলেন রোগী কে নিজের আপনজন ভাবতে, আপনজনের জন্য মানুষ যেভাবে করে সেভাবে রোগীর সেবা করতে, বাস্তবিকে সেটা সম্ভব হয় না, কেন সম্ভব হয় না জানেন? কারণ আমরা কেউ কাউকে আপন ভাবতে পারি না, না ডাক্তার রোগী কে, না রোগী ডাক্তার কে....।

একজন রোগী যেমন কারো না কারো বাবা, ভাই, মা, বোন, ঠিক তেমনি একজন ডাক্তার বা নার্সও কারো না কারো আত্মীয় এটা আমরা ভুলে যাই, মনে রাখি না...।

সত্যিটা হচ্ছে আমরা বাঙালিরা জাতিগতভাবে অসভ্য, এমনকি আমরা যারা নামের আগে ডাক্তার বসাতে পেরেছি, তারাও...
আমি মাঝেমধ্যেই ভাবি দীর্ঘদিন ধরে এই পেশায় সংশ্লিষ্ট না থাকলে আমরা ডাক্তাররাও কজন এই সমস্ত রোগীর লোকের মত করে ভাবতাম না? আমরাও হয়তো ভাবতাম এভাবেই, কারণ লোভ আর অকৃতজ্ঞতা আমাদের রক্তে...।

একটা সরকারী হাসপাতালে নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন আছে, সকল রোগী কে সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে সেটাও নিয়ম, তবুও কোন কোন গুরুতর অসুস্থ রোগী বা গরীব রোগী বা বিরল রোগে রোগাক্রান্তদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্হা নেয়া হয়, যেমনটা হয়েছে বাজনদার এর ক্ষেত্রে..
তার এই প্রতিদান?

একটা রোগী যদি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে চায় তাকে চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে, এমনকি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকতে চায় সেক্ষেত্রেও চিকিৎসক এর অনুমতি লাগবে, কেউ এটা মানতে চায় না, হাসপাতাল কে আমরা মনে করি মামাবাড়ি, যখন খুশি আসলাম, যে রোগ প্রাথমিক অবস্হায় আসলে সেরে যেত, নিজেদের অবহেলায় তাকে জটিল করে মরার আগে ওষুধ খেতে আসবো, তারপর রোগ ভালো না হলে ডাক্তার নার্সকে অভিযুক্ত করে চলে যাবো, এটা কোন সভ্য দেশের চিকিৎসা সংস্কৃতি হতে পারে?

চিকিৎসকরা কেউ ধোয়া তুলসী পাতাও না, আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতাও না, আপনার আমার মতই রক্তমাংসের মানুষ, সুতরাং তাদের কাছে মানুষ হিসেবে সেই আচরণটাই প্রত্যাশা করতে হবে এগুলো জনগণ আর কবে বুঝবে?
রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করালেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, এই অবাধ প্রচারণা, উদ্বুদ্ধকরণ এর যুগেও মানুষ নিজের আত্মীয়স্বজনের জন্য রক্ত জোগাড় করতে চায়না নিজেরা, চিকিৎসক কে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেনা, চিকিৎসক এর চেয়েও বেশী বিশ্বাস করে মুদি দোকানদার কে, ফার্মেসীওয়ালাকে, সাংবাদিক এর ভুল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ কে...।

আমরা সবাই উন্নত বিশ্বের মানের চিকিৎসা চাই,
কিন্তু নিজেরা রোগী হিসেবে, রোগীর লোক হিসেবে নিজেদের মানসিকতা উন্নত করতে মোটেও রাজি না ।
তাহলে এই বাজে, বিশৃঙ্খল চিকিৎসা সংস্কৃতি নিয়ে একটা দেশের স্বাস্হ্যব্যবস্হা কিভাবে এগোবে?
সবচেয়ে অদক্ষ যেই চিকিৎসক, সবচেয়ে অর্থোলোভী যেই চিকিৎসক সেই খারাপ মানুষটাও চান তাঁর রোগী সুস্হ হোক...
আমরা রোগীর লোক হিসেবে আমরা কি তাঁদের এই চাওয়াটা বুঝি, চেষ্টা করি কখনো?
নাকি সারাজীবন ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে সাংবাদিক ডেকে ডাক্তারদের উপর চড়াও হবো, হাসপাতাল ভাঙচুর করবো আর বিল কিভাবে কম দিতে হয়, সামর্থ্যবান হয়েও কিভাবে ফ্রি ওষুধ, পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হয় তার ছুতো খুঁজতে থাকবো?


এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সময় এসেছে,
দেশের স্বাস্হ্য ব্যবস্হায় অনেক ত্রুটি, অনেক সীমাবদ্ধতা, সরকার এবং চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করছে সেসব কাটিয়ে উঠে একটা গণবান্ধব স্বাস্হ্যসেবার প্রক্রিয়া দাঁড় করাতে।


আমরা সাধারণ জনগণ যারা রোগী বা রোগীর লোক আমরা কি এই কর্মযজ্ঞে নিজেদের সুচিন্তিত বিবেকসম্পন্ন ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত আদৌ নাকি কেবল এসব কিছুর সুবিধাভোগী হবার চেষ্টায়ই লিপ্ত থাকবো যেকোন উপায়ে?
ডাঃ সামন্তলাল সেন স্যার একদজন পথিকৃৎ,
তাঁকেও কটু কথা শোনাতে ছাড়িনা আমরা,
আমরা কি আসলে তাঁর চিকিৎসা পাওয়ার যোগ্য?
অথচ এই আমরাই অযথা দেশের বাইরে যাচ্ছি হরহামেশাই, একেবারে রাষ্ট্রপতি থেকে সাধারণ জনগণ সবাই, সেসব দেশে কেউ ফ্রি তে চিকিৎসা করায় না, গরীব দেশ বলে কেউ দয়া-দাক্ষিণাও দেখায় না, সেখানকার চিকিৎসাব্যবস্হা আহামরি খুব উন্নতও না।
কমবেশী একই...।
এমনকি এই দেশে যে সার্জারি হরহামেশাই হয় এবং তারপর সেই রোগী ভালো হয়ে যায় বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ সেই একই সার্জারি আমেরিকায় করিয়েও সুফল পাননি, তাহলে?
চিকিৎসকদের পান থেকে চুন সব দেশেই খসে,
কিন্তু তার জন্য তুলকালাম কান্ড কেবল আমাদের দেশেই ঘটে, এটাই আফসোস...।
জাতিগতভাবে বর্বর, অসভ্য, বেইমান আর বড্ড অকৃতজ্ঞ আমরা, আবুল বাজনদার বা আমি বা আপনি প্রতিদিন কোন না কোন হাসপাতালে আমাদের জাতিগত মানসপট এর সেই চিত্রটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছি নির্বিকারচিত্তে...।

______________________________
সৈয়দ শাওন । সুলেখক। লোকসেবী চিকিৎসক।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়