Ameen Qudir

Published:
2018-04-06 19:51:53 BdST

রোগী কথনওয়ার্ড জুড়ে বেদনায় বিদীর্ণ মায়ের কান্না আর সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর আনন্দ চিৎকার


 

 

 

ডা.ছাবিকুন নাহার
________________________________

বছর সাত আট আগের কথা। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ট্রেনিং করি। এফসিপিএস দ্বিতীয় পর্বের ট্রেনিং। অবস্ এন্ড গাইনীতে। এডমিশান ইভনিং ডিউটি। লেবার ওয়ার্ড। সরকারি হাসপাতাল তাও আবার মিটফোর্ডের মতো হাসপাতাল! আর এডমিশান যে কী জিনিষ তা ভূক্তভোগী ছাড়া বোঝানো কষ্টকর। ওয়ার্ড জুড়ে প্রসববেদনায় বিদীর্ণ মায়ের কান্না আর সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর আনন্দ চিৎকার মাখামাখি। একই সাথে কান্না এবং আনন্দের যুগোপৎ ভিন্ন অনুরণন।

এক মা এসেছেন যার গর্ভের সন্তানের একটা হাত বেরিয়ে আসছে! হ্যান্ড প্রলাপস। পরীক্ষা করে দেখা গেলো হার্টবিট এখনো আছে। মেডিকেল ইমার্জেন্সি। একদল কমরেড ইমার্জেন্সি সিজার করতে দৌড়ালো।

আরেকজন নারী। পরপর আগের দুটো সন্তান লস।
তিন মাসের গর্ভবতী। অথচ তার সন্তান এবারো আগেভাগেই পৃথিবীতে চলে আসার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছে। এবং রওয়ানাও দিয়ে দিয়েছে। যাত্রাপথের মাঝখানে আঁটকে আছে। মায়ের জীবনটা হাতে নিয়ে। মা রক্তে ভাসছে ডুবছে। অবেলায় সন্তান হারানো মায়ের কান্না বর্ননা করার স্পর্ধা আমার নেই। 
যে দেখেছে, সে কখনো ভুলতে পারবে বলে মনে হয়না। শুধু এটুকুই বললাম।

এমন সময় এক মায়ের আগমন। বানের জলের মতো রক্ত যাচ্ছে জন্মপথ দিয়ে। কল কল করে। ভয়ংকর অবস্থা। হিস্ট্রি নিয়ে জানলাম, কিছুক্ষণ আগে সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে। বাসায়। বংশাল। জায়গাটা একটু নোট করুন। কারণ পরে বলছি। একা একা জন্মদান সহজ কথা নয়। বাচ্চা জন্মানোর পর রক্ত যাচ্ছিল। ট্যাপে ছেড়ে দিলে যেমন করে পানি পড়ে, তেমন করে। জরায়ুজ রক্ত যখন ফ্লোর বেয়ে বাইরে এসেছে তখন নাকি প্রতিবেশীরা বুঝতে পেরেছে। এবং দয়া করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।

একটা তথ্য, সমস্ত শরীরে রক্ত থাকে ছয় লিটারের মতো। এখন একটি অংক করেন তো দেখি, কল ছেড়ে দিলে ছয় লিটার পরিমান পানি পড়তে কত সময় লাগবে? আমার রোগী যখন হাসপালে পৌঁছল তখন তার সবটুকু রক্ত বাড়িতে রেখে এসেছে।

মুখটা একেবারে রক্তশূন্য। একেবারে পেপার হোয়াইট যাকে বলে। পালস, ব্লাড প্রেশার রেকোর্ডেবল না। শ্বাস কষ্ট ভয়াবহ পর্যায়ের। শরীরের তাপমাত্রা হিমশীতল। সমস্ত শিরা কলাপ্সড। ইরেভার্সিবল শক।

চ্যানেল ওপেন করা যাচ্ছে না। তারপরও দুইটা চ্যানেল দুই হাতে দেয়া হলো। অনেক কষ্ট করে। ইউটেরোটনিক ড্রাগ, ইউটেরাইন ম্যাসেজ, বাই ম্যানুয়াল কম্প্রেশন, ইউটেরাইন টেম্পোনেন্ড এবং আরো কত কী! রক্ত বন্ধ করার সমস্ত প্রয়াসকে থোরাই কেয়ার করে রক্ত যেতেই থাকল, যেতেই থাকল। সব ভাসিয়ে, সব ছাপিয়ে। যাওয়ার আগে ডুবে যাওয়া কন্ঠে শুধু মাত্র বলতে পারল, পা...নি...। খুব আস্তে। অস্ফুট স্বরে। স্যালাইন থেকে সিরিঞ্জে করে দু ফোঁটা পানি মুখে দিতে পারলাম মাত্র। তারপর সব শেষ।

পিপিএইচ। পোষ্ট পার্টাম হেমোরেজ। প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ। প্রসব পরবর্তী ও পূর্ববর্তী রক্তক্ষরণ 
মাতৃমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। শতকরা একত্রিশ ভাগ। এরা খুব সহজে মায়ের জীবন নিয়ে নেয়। কিছু বোঝার আগে। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, যার যায় সে বোঝে। আর বোঝে মাতৃহারা সন্তান।

আমি এখনো হিসাব করি, বংশাল থেকে মিটফোর্ডের দুরত্ব কত? ডেলিভারি প্রসেস শুরু হওয়ার পর যদি হামাগুড়ি দিয়েও আসত। তাহলেও তো দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। হাসপালে ডেলিভারি হলে এমনতর হয়তো হতো না। আর হলেও তড়িৎ মোকাবেলা করা যেতো।

এখনো আক্ষেপটা লেগে আছে! যদি আর একটু আগে আসত! যদি আরেকটু সময় দিতো? তাহলে তো সদ্যজাত সন্তানটা অন্তত মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত হতো না। আহারে মা! তোমার সন্তানদের কোথায় রেখে গেলে? নিজের জীবনটাকে এতো অবহেলা করতে হয়? এটা অন্যায়। জানোনা মা হারা সন্তানের মতো অসহায় কেউ নেই? অভাগা কেউ নেই।
_______________________________

ডা.ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়