Ameen Qudir

Published:
2017-05-15 21:11:28 BdST

দ্বীপের একমাত্র রূপোপজীবীনী নাফিসার কাছে যে জন্যে যেতেই হত



ডা. মোরশেদ হাসান

______________________

 

আমাকে বলতে গেলে সপ্তাহে একদিন নাফিসার কাছে যেতে হয়। এ ব্যাপারে নাফিসাই ভালো। নাফিসা এ দ্বীপের একমাত্র রূপোপজীবীনী।
আমি প্রকাশ্যেই ওর কাছে যাই। আগে একটু সংকোচ বোধ হত। পরে দ্বীপের আবহাওয়া বুঝে ফেললাম সংকোচ বলে এক জিনিস এদের অভিধানে নেই।

এখানে যার যার কাজে সে স্বাধীন। অন্য কেউ তার কাজে ইন্টারফেয়ার করে না। কদাচিৎ পরস্পরের মধ্যে ঝামেলা লাগলে তা মিটমাটের জন্য কাউন্সিল অফিস আছে। তবে এরা মারামারি, হাতাহাতি করে না। কাভি নেহি। এটাও মনে হয় ওদের ডিকশনারিতে নেই। আমি একবার মসজিদের ইমাম ইসমাইল বেবের ছেলে এ লেভেল পড়ুয়া রাহুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
আচ্ছা রাহুল তুমি তো হিন্দি সিনেমা মাঝে মাঝে দ্যাখো। সেখানে মারামারিও দেখেছ। ধরো, তোমাকে কেউ এমন একটা কথা বলল যেখানে গায়ে হাত তুলতেই হয়। না তুলে পারা যায় না। সেক্ষেত্রে তুমি কী করবে?
রাহুল বলল, সেক্ষেত্রে আমি ওর গায়ের কাছে গিয়ে দুটো কঠিন কথা শুনিয়ে দেব।
-তার মানে গায়ে হাত দেবে না।
-না।

এই হচ্ছে এই সমাজের রীতি। মারামারি করা এদের ধাতে নেই। চিৎকার-চেঁচামেচিও করে না। যে যার কাজ সিস্টেম ওয়াইজ করে যাচ্ছে। তা-ই বলে মহামানব এরা--আমি মোটেই তা বোঝাতে চাইছি না বা প্রকাশ করতে চাইছি না।
নাফিসার কথায় ফিরে যাই। নাফিসা মাঝে মাঝে হেলথ সেন্টারে বাকি সবার মতোই চিকিৎসার জন্য আসে। বেশ স্মার্ট মেয়ে। স্মার্ট মেয়ে বললে লেখ্য ভাষায় ঠিক বোঝানো যায় না। স্মার্ট বললে তার পেশা অনুযায়ী উগ্র আধুনিক মনে হতে পারে তাকে। সেরকম কিছুই না। স্বচ্ছন্দ বলা যেতে পারে। পরনে জিনস ও টপস পরা থাকে। ইংরেজি কথোপকথন বেশ ভালো। চোখ দুটোতে গভীরতা ও নিরীহ দৃষ্টি একই সঙ্গে মেশানো। এই মেয়েটিকে বাইরেও দেখি সচরাচর সাইকেল চালিয়ে দোকানে যাচ্ছে।

মানুষ যে সমাজে বড় হয় সে সমাজের কাঠামো তার মাথাকে আচ্ছন্ন বা গ্রাস করে ফেলে; যা থেকে সে সহজে বের হতে পারে না। বাইরের সমাজে ভিন্ন কিছু দেখলে সে বড় একটি ধাক্কা খায়। আমাদের সমাজে রূপোপজীবীনী বলতেই ঠোঁটে সাধারণ লিপস্টিকের কয়েক আস্তর মেখে রাখা, উগ্র সাজসজ্জা, গালে ততোধিক সস্তার পাউডার মেখে অঙ্গভঙ্গি করে খদ্দের আকর্ষণের চেষ্টা করে এ রকম ছবি ভেসে ওঠে। এখানে যা দেখলাম কড়া মেকআপ তো দূরের কথা ঠোঁটেও লিপস্টিক দেয় না।

এখানে রাস্তাঘাটে হাল কিহিনে বা আসসালামু আলাইকুম বলা নিয়ম। আমি সবার সঙ্গে বা সবাই আমার সঙ্গে সম্ভাষণ বিনিময় করেন। হাল কিহিনের উত্তরে রাঙালু বলার নিয়ম। আমাদের দেশে রাঙা ভাই বা রাঙা দিদি আছে, অথবা রাঙালো তো সাহিত্যিক শব্দ। আজি এ প্রভাতে আমার হৃদয় এমন করে কে রাঙালো?—রাঙালো মানে শুভ্র, ফরসা বা ভালো। কেমন আছেন--এর উত্তরে খারাপ কেউ বলেন না। আর বললে সেটা এখানে স্যাকারা। স্যাকারা মানেই খারাপ। জিনিস, ঘটনা, মানুষ স্যাকারা বললে সেটির ব্যাপারে মানুষ খুব হতাশা প্রকাশ করে বলে, স্যাকারা দো। দো হল একটা আদুরে অর্থহীন শব্দ, আমাদের দেশের হ্যাঁগো, ওগো’র গো’র মতো।

 

নাফিসার সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে ইংরেজি বা দিবেহি ভাষায় টুকটাক কথা হয়। একবার রাতে স্টেডিয়ামে ফ্লাড লাইটের আলোয় মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছে। ফাইনালের দিন আমাকে অফিস থেকে বলা হল সবাই যাবে আমিও যেন যাই। যাব তো বটেই। মেয়েদের ফুটবল খেলা একটা ভিন্ন আকর্ষণ বহন করে নিয়ে আসে এটা পুরুষ হয়ে অস্বীকার করি কী করে? কিন্তু আমার ভুলো মনের স্বভাবের জন্য সব গড়বড় হয়ে গেল। যথারীতি টাইম ভুলে বসে আছি। পরদিন ইন্টারপ্রেটর সাহুমা আমাকে বলল, কাল তো ফুটবলে আমরা হেরেছি। এখানে দুটো গ্রুপে খেলা হয়। উত্তরু গ্রুপ ও দেখুনু গ্রুপ; সোজা কথায় উত্তর আর দক্ষিণ। তখনি আমার মনে পড়ল আমার ভুলো মনের জন্য আমি খেলা মিস করেছি। তা এখন আর আফসোস করে কী হবে?
সাহুমা উত্তরু গ্রুপে থাকে। জিজ্ঞাসা করলাম হেরে গেলে সাহুমা? দেখুনু গ্রুপ কি তোমাদের চেয়ে শক্তিশালী?
-নাফিসার সাথেই তো পারা যায় না। সে একাই ছয়টা গোল দিয়েছে।
--কোন নাফিসা? সে-ই!
সাহুমা হাসে।
সাহুমার হাসি দূরে ঠেলে আমি অবচেতন মনে দেখি নাফিসা একের পর এক গোল দিচ্ছে। আর স্টেডিয়ামের চারদিক থেকে নারী-পুরুষ সমস্বরে চিৎকার করছে নাফিসা…নাফিসা-আ…। এইদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। মাঠের চারপাশ থেকে নারী-পুরুষ মুহুর্মুহু সমস্বরে নিজের দল ও প্লেয়ারের নাম ধরে সমর্থন দিতে থাকে।
আমি পরে একদিন নাফিসার খেলা দেখেছি স্টেডিয়ামে। বলের ওপর দখল ভালো। শ্যুটও ভালো করে।

নাফিসার দু’ছেলে এক মেয়ে। এদের বাবার পরিচয় নেই। স্কুলে সুন্দরভাবে বাকি সবার সঙ্গে পড়ছে। বিকালবেলায় সব শিশুদের সঙ্গে একসঙ্গে জেটিতে খেলাধুলা করে। দ্বীপে আসার প্রথমদিকে একদিন মসজিদ থেকে বের হতে গিয়ে তো আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। দেখি নাফিসা সাইকেল নিয়ে মসজিদের বাউন্ডারির সামনে দাঁড়ানো।

তখনও দ্বীপের বাউ ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারিনি। আতঙ্কে অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুসল্লিরা বের হয়ে কী জানি তুলকালাম কাণ্ড করে ওকে দেখে। আমাকে হতাশ করে দিয়ে কিছুই হল না। মুসল্লিরা যার যার মতো বেরিয়ে যাচ্ছেন। বস্তুত আমি ছাড়া কেউ তার দিকে তাকাচ্ছেও না। হঠাৎ একটি ছোট ছেলেকে মসজিদ থেকে বের হয়ে মাম্মা বলে দৌড়ে গিয়ে নাফিসার সাইকেলের পেছনে বসে রওয়ানা হয়ে যেতে দেখলাম।

দ্বীপে আসার পর নবাগত আমি দ্বীপের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত হই বাঙালি শ্রমিকদের দ্বারা। এর মধ্যে একজন ছিল টাঙ্গাইলের মুজিবর। সে অনেক কিছুর সঙ্গে আমাকে নাফিসাকেও দেখিয়ে দেয়। মুজিবর রাতের বেলায় হাজির হয় নাফিসার নিভৃত অঙ্গনে। সে অঙ্গন আদিম।
আমিও যাই নাফিসার কাছে। নাফিসার বাসা জেটির কাছে। বিকালবেলায় এখানে সাগরের দিগন্তরেখায় আকাশ মেঘের বিপুল ও অপরূপ রঙে সজ্জিত হয়। এ দৃশ্য যে এক জীবনে দ্যাখেনি সে হতভাগা। আমার সাইকেলটির চাকার হাওয়া শেষ হয়ে গেলে জেটিতে যাওয়ার পথে নাফিসার বাসার সামনে গিয়ে ডাক দিই।
নাফিসা।
লম্বা কালো করে মেয়েটি এসে হাজির হয়। আমি বলি, নাফিসা, হাউ আর ইউ?
-আই অ্যাম ফাইন।
-নাফিসা, আই নিড টু পাম্প মাই বাইসাইকেল। উড ইউ প্লিজ ব্রিং ইউর পাম্পার। আশেপাশে জোলিতে বসা মহিলারা হেসে ওঠেন। তাঁরা বলেন, ডাক্তারু তোমাকে কতবার বলেছি পাম্পার নয়, এটা হচ্ছে বুম্বা।
আমার দিবেহি ভাষা মনে থাকে না। আমতা আমতা করে বলি, ইঙ্গে ইঙ্গে, মিহারু মি বুম্বা বুনানি (জি জি বুঝেছি, এখন থেকে আমি বুম্বা বলব)।
নাফিসা কিছুক্ষণ পর নিরীহ শান্ত ভঙিতে বুম্বা নিয়ে এসে হাজির হয়।
____________________________

ডা. মোরশেদ হাসান ।
সুলেখক

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়