Ameen Qudir

Published:
2018-09-27 23:12:29 BdST

আমার মা আমি এবং আমরা : প্রথম আয়ের আনন্দ


লেখকের ছবি


ডা. ছাবিকুন নাহার
__________________________

ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা ভালো হয়নি। পরিমাপের অংকে টাকা পয়সার হিসাব মেলাতে পারিনি। এদিকে এপ্লিকেশনের ফরমেট ঠিকঠাক দিয়েছি, কিন্তু বিষয়বস্তু আওতার বাইরে, তাই লিখতে পারিনি। বৃত্তি পরীক্ষায় সব লিখেও শিকে ছিড়ে না, আর আমি তো টুকটাক বাদ দিয়েছি। বৃত্তি আর আমার পাওয়া হলো না। কষ্ট লাগছে ভাইয়ার জন্য। বেচারা কী ইফোর্টটাই না দেন আমার পড়াশোনায়! আমি আমার বাবা আর ভাইয়ার চেহারা আলাদা করতে পারিনা, করিও না। আজকের আমি পুরোটাই আমার ভাইয়ের গড়া বললে কম বলা হয়। অবশ্য আমাদের ভাইবোনের সবারই মনেহয়, একজনের সাফল্যে আমরা অন্যজন মিলে থাকি। বইয়ের পাতার মতো প্রত্যেকে ভিন্ন গল্প বুকে ধারন করলেও, আমরা এক ও অভিন্ন। একপাতা পড়তে গিয়ে মনের ভুলে অন্যপাতায় যেমন চলে যাওয়া হয়, তেমনি আমাদের একজনের গল্পে অন্যজন অবধারিতভাবে চলে আসে। এই যেমন এখনে বড় ভাইয়া চলে এলো।

ছোটবোনের বৃত্তি হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়ার দুঃখে কিছুদিন বড় ভাইয়ার শীতল মনখারাপ থাকবে, না বললেও আমি বুঝতে পারি। সেই কষ্টে আমিও আউলা ঝাউলা হয়ে এখানে ওখানে বসে থাকি। কিছুই ভালোলাগে না অবস্থা। এমনি এক সময়ে দক্ষিণ পাড়ার নাসির, একই ক্লাসে পড়ে, ছুঁটতে ছুঁটতে এসে হরবর করে যা বলল তার শানে নজুল হচ্ছে আমি বৃত্তি পেয়েছি! আমি বৃত্তি পেয়েছি! ইয়াহু, ভাইয়া বলে বিকট এক চিৎকার দিলাম! ভাইয়ার উদ্ভাসিত মুখটা আমি এখনো মনে করতে পারি! আমার যেকোনো সাফল্যে এখনো আমি সেই মুখটা খু্ঁজি।

বৃত্তি তো পাওয়া হলো৷ পরবর্তীতে কিছু টাকাও পেয়েছিলাম সে উপলক্ষে। ঠিক কত তা এখন আর মনে নেই। তবে ক্লাস এইটের মেয়ের জন্য সেটা মনেহয় তখন বেশিই ছিলো। টাকাটা কী করা যায় সেটাই তখন আমার প্রধান চিন্তা। বাবাকে কিছু দিয়েছিলাম। তিনি নাকি সবাইকে চা খাওয়াচ্ছেন আর বলছেন, আমার মেয়ের বৃত্তির টাকায় চা। বলতে বলতে বাবার চোখ আনন্দে চিকচিক করছে! উল্লেখ্য যে, আমার বাবার প্রধান খাদ্য ছিলো চা। সেটা আবার দোকানের, দলবলসহ। তারপর বাবাকে আর মাত্র বছর খানেক পেয়েছিলাম। বাবা আমি নাইনে থাকতে মারা যান।

আমার বাবা মায়ের কেমিষ্ট্রি ছিলো অসাধারণ! বাবার কাছে মা ছিলেন, ছোট্ট একটা পাখির মতো। যাকে বাবা দৈনন্দিন সমস্ত ঝামেলার বাইরে রাখতেন। কোনো দিনও আমরা আমাদের বাবা মায়ের মধ্যে হিচিং দেখিনি। কোনকিছু ঠিকঠাক না পেয়েও ঠিকঠাক জীবন যাপন করাটা শিখেছি আমার মা বাবার কাছ থেকে। এ ব্যপারে তারা ছিলেন কিংবদন্তী তুল্য। মায়ের দারুণ কিছু গয়না ঘাটি ছিলো। সংসারের প্রয়োজনে সেগুলির সদগতি করা হতো। মায়ের বালা জোড়ার এমনি এক গতি হয়েছিলো। এতে বাবার মনে কিছুটা আক্ষেপ থাকলেও, মায়ের মনে কখনো কিছু ছিলোনা। মা বরং প্রসন্নই ছিলেন। তারপরও মায়ের খোলা হাত দেখে মনে হলো এক জোড়া চুড়ি বানাই। হোক তা রুপার। আমার টাকার এরচেয়ে সুন্দর ব্যবহার আর হতেই পারেনা। চুড়ি জোড়া এনে মাকে যখন পরিয়ে দিলাম, মা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলেন! তারপর আড়ালে চোখ মুছলেন। ভেজা আর্দ্র মায়ের চোখে আমি সেদিন স্বর্গ দেখেছিলাম। এরপর আমার আর নতুন কোন স্বর্গের প্রয়োজন হয়নি।

ইন্টার্ণীর শেষে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং এ ঢুকে যাই। বরিশালে আরো মাস ছয়েক থাকতে হবে। কথার ফাঁকে ম্যাডামের এক রোগীর ইমার্জেন্সি ডিএনসি লাগল। আমি এ্যাসিস্ট করলাম। কাজ শেষে ম্যাডাম আমার হাতে তিনশত টাকা গুঁজে দিলেন! আমি নিতে চাইনি। কতই তো এমন রাত দিন কাজ করেছি হাসপাতালে। ম্যাডাম বল্লেন,

আরেহ! এটা তোমার উপার্জন। কেনো নেবে না?

আমার উপার্জন! প্রথম উপার্জন। ডাক্তার হিসাবে স্বীকৃতি! খুব কেঁপেছিলাম তিরতির ভালোলাগায়! এরপর বিসিএস, টুকটাক প্রাকটিস...কিন্তু প্রথম বারের সেই অনুভূতি কিছুতেই ছাঁপিয়ে যেতে পারিনি আজো।

ইন্টার্নশিপের প্রথম বেতনের টাকা যখন হাতে পাই, মা তখন বরিশাল মেডিকেলে ভর্তি। মায়ের জরায়ু অপারেশন হবে। ইউটেরাইন প্রলাপস। সবকটি টাকা মায়ের হাতে দিলাম। মা গুনে গুনে দেখলেন, তারপর আমার হাতে দিলেন। আমি সব ভাইবোনের জন্য একটু একটু করে কিছু কিনলাম। মা এখনো সেই গল্প করেন। মায়েরা আসলে কিচ্ছু চান না তেমন, তবে সন্তানদের মনোযোগ চান, ভালোবাসা চান।

বলছিলাম মায়ের জরায়ু অপারেশনের কথা। আমার মায়ের ইউটেরাইন প্রলাপ্স হয়েছিল। প্রলাপ্স মানে জরায়ুর অবস্থান ডিসপ্লেসড হয়ে বাইরে বের হয়ে আসা। বাইরে বের হওয়া জরায়ু এন্টিসেপ্টিক গজ দিয়ে রি পজিশন করে রাখতে হয়, অপারেশনের দিন কয়েক আগ পর্যন্ত। এতে জরায়ুর রক্ত চলাচল বাড়ে। এতে অপারেশন, অপারেশন পরবর্তী ঝামেলা কম হয় এনং দ্রুত হিল হয়।

আমি রেগুলার ড্রেসিং করে প্যাক দিয়ে দিতাম। মা প্রথম প্রথম ইতস্তত করতেন। পরে আস্তে আস্তে সহজ হন। মাকে মনে হতো আমার মেয়ে। ছোট বেলায় যেমন করে আমাকে আমাদেরকে নেপি চেঞ্জ করে দিতেন। আমিও তেমনটা না হলেও কাছাকাছি কিছুটা করছি! আমি আমার অন্য ডাক্তার বান্ধবীদের দিয়ে কাজটি করাতে পারতাম, কিন্তু আমার মনে হলো, যার জন্মপথ ধরে এই পৃথিবীর রং রুপ গন্ধ চিনেছি, সেই জন্মপথে সমস্যা হলে সন্তান ছাড়া আর কে থাকবে বেশি প্রাইভেসি মেনটেইনে?

জরায়ু অনেক কারনেই ডিসপ্লেসড হতে পারে। জন্মগত উইকনেস, ঘনঘন বাচ্চা জন্মদান, ডেলিভারির মিস ম্যানেজমেন্ট, বাচ্চা জন্মের পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নেওয়া এবং সংসারের ভারী কাজে ফেরা। আরো অনেক কারণ থাকে।

যাহোক আমার মা অপারেশনের পর দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠলেন। ডিসচার্জের দিন সেলিনা পারভীন ম্যাডাম মাকে অনেক কথাই বলেছিলেন, তারমধ্যে একটি ছিলো এমন, "মা আমি দোয়া করি সব ঘরেই আপনার মেয়ের মতো একটি মেয়ে থাকুক। যে তার মাকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করবে।" এ পর্যন্ত পাওয়া এটাই আমার বেষ্ট কমপ্লিমেন্ট।

বসেছিলাম প্রথম আয়ের আনন্দের কথা লিখতে, লিখলাম মাকে নিয়ে। কোন ফাঁকে যে রোগ শোকও ঢুকে গেলো! আজকাল এই হয়, যখন তখন রোগী কথন চলে আসে। শুধু অতর্কিত চলেই আসেনা, আপনাদের সাথে শেয়ার না করা পর্যন্ত গ্যাট হয়ে বসে থাকে, মাথা থেকে নামতেই চায় না।

যাহোক বলছিলাম কি, আমাদের অনেকেরই মা আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছেন। একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন তো মায়ের জরায়ুটা, যেখানে আমরা সন্তানেরা পরম আয়েশে থাকতাম, তা ঠিকঠাক আছে কিনা? ডিসপ্লেসড হয়ে যায়নি তো? কেননা এই রোগটা মায়েদের বেশি হয়।
মায়েরা কিন্তু তাদের কষ্টের কথা কখনো বলতে চান না, কিন্তু আমরা তো জানতে পারি, নাকি?

নিজে মা হয়েছি, এখন বুঝি সন্তানদের ছোট ছোট কথাতে কত্ত আনন্দ লাগে! আবার একটু অন্য রকম দেখলে চোখ জলে ভরে। বিশ্বাস করেন আমারতো সন্তানের চকলেটেও ভাগ বসাতে ইচ্ছা করে! ইচ্ছা করে সন্তানদের মিছেমিছির ঘর সংসারে আমার একটা অংশ থাকুক। সন্তান তার অলিন্দ নীলয়ে বুড়ো বুড়ি বাবা মায়ের জন্য একটা আসন রাখুক। সন্তানের হাসি আনন্দ, ভালোলাগা মন্দলাগা,
কষ্ট সাফল্যে সবকিছুতে বেয়ারার মতো লেগে থাকতে ইচ্ছা করে। আমি চাই আমার, আমাদের সন্তান ও এমন বেয়াড়া হোক, নাছোড়বান্দা হোক। মা বাবার জন্য বেয়াড়া সন্তান খুব দরকার এ জগৎ সংসারে।
________________________________


ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়