Ameen Qudir

Published:
2018-04-06 21:13:55 BdST

মেডিকেল শিক্ষা জীবনের নেপথ্যে প্রতিনিয়ত বাজতে থাকে যে করুণ সুর


এটি প্রতিকী ফাইল ছবি। ছবির মডেল বাংলাদেশ বা পশ্চিম বঙ্গের নয়। প্রতিবেদনের মর্মার্থে ছবিটি ব্যবহার করা হল। 

 

ডা. মাহবুব হোসেন
___________________________

“কুমিল্লা মেডিকেলের একজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছেন” শিরোনাম দেখে খবরের পুরোটা পড়লাম। তিনি আমার সমসাময়িক ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন, চূড়ান্ত পেশাগত এমবিবিএস পরীক্ষায় গত পাঁচ বছর ধরে তিনি পাশ করতে পারেননি। একজন মানুষের পক্ষে এটা কতটা যন্ত্রণার সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।

চোখের সামনে সহপাঠীরা পুরোদস্তুর ডাক্তার হয়ে ডিউটি করে বেড়ায়, পুরো পরিবারের সবাই আশায় আশায় বসে থাকে কবে ছেলেটা ডাক্তার হবে, হয়তো অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চলে যায় কাছের মানুষটিও। এইসব যাতনা সহ্য করে পাঁচ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। শেষ অব্দি মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন, গ্যালারিতে বসা আমাদের শিক্ষাব্যবস্হার কুশীলবদের থেকে শুরু করে দূরে থাকা আমাদের সবাইকে জানিয়ে গেলেন, এই কাঠামোয় একজন মানুষের বেঁচে থাকা কত কঠিন। মেডিকেলের অনেক স্যারই গৌরব করে বলেন, “মেডিকেলে কেউ পাশ করে না, স্যারেরা পাশ করান”। ভাবখানা এই রকম যে উনাদের দাক্ষিণ্য না পেলে পাশ করবার মতো ক্ষমতা কারো নেই। নিজের সন্তানসম শিক্ষার্থীকে কতটা নিচু দৃষ্টিতে দেখলে এমন মন্তব্য করা যায় তা ভাবা কঠিন। ব্যতিক্রম নেই তা বলছি না, তবে গড়ে অধিকাংশ অধ্যাপক এই মনস্তত্ত্ব ধারণ করেন।

তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর কারণে ছাত্রের ফেল করিয়ে যে অধ্যাপক পৈশাচিক আনন্দ পান, সেই অধ্যাপককেই দেখা যায় রাজনৈতিক নেতার প্রভাবে অথবা সিনিয়র চিকিৎসকের সন্তানদের হাস্যকর প্রশ্ন করে পাশ করিয়ে দিতে। এই দ্বৈত মানসিকতা নিয়ে তারা অধ্যাপনা করেন কীভাবে? তাছাড়া পরীক্ষায় যতটা না ছাত্রের মূল্যায়ন হয় তারচেয়ে ঢের বেশি মূল্যায়ন হয় শিক্ষকের। বন্ধুপ্রতিম এক পিএইচডি গবেষকের কাছে শুনছিলাম, তার অধ্যাপক নাকি থিসিস উপস্থাপনার আগের রাতে ঘুমাতে পারননি ছাত্রটি কেমন করবে- এই চিন্তায়। আমাদের তেমন শিক্ষক কোথায়? পরীক্ষায় কেউ খারাপ করতেই পারেন, কিন্তু সেটা কি শুধু ঐ ছাত্রটির ব্যর্থতা? তাকে যারা মেডিসিন পড়িয়েছিলেন, তাদের মূল্যায়ন কে করবে? আমাদের মেডিকেল এডুকেশনে পাশ করাবার কোন বস্তু-নিরপেক্ষ মানদণ্ড নেই, এক বোর্ডে পাশ তো অন্য বোর্ডে লাশ হয়ে যাওয়া কঠিন কিছু না।

এছাড়া একেক বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেলে একেক প্রশ্নপত্রে একেক কায়দায় পরীক্ষা হয়, ফলে পাশ করা ডাক্তারদের মধ্যেও মানের ফারাক থাকে বিস্তর। এই ডাক্তারেরা পাঁচ-দশ বছর প্র্যাকটিস করার পর এদের ধরে এনে আবার ফাইনাল প্রফ নিলে অনেকেই ফেল করবেন। এদের কথা বাদ থাকুক, যেই স্যারেরা ছাত্রটিকে মেডিসিনে ফেল করালেন, তাদের যদি প্রফ নেয়া হয় তাহলে অনেকেই কৃতিত্বের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে ডাব্বা মারবেন।

কেবল একটি পরীক্ষা দিয়ে কারো জ্ঞানের বিচার করা যায় না-এই সত্য অনুভব করে যদি কোন শিক্ষক ফেল করা ছাত্রের সাথে আলাপ করে যদি দেখতেন কেন সে খারাপ করছে, তাহলে ছাত্রটির জীবন বেঁচে যাবার সম্ভাবনা থাকত। হয়তো আরও অনেক আগেই সে পাশ করে যেত, জীবনের যুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকত আজও। সেইটুকু সময় আমাদের শিক্ষকদের কোথায়! এছাড়া সব মেডিকেলেই সাইকিয়াট্রি বিভাগ আছে, রোগী দেখার বাইরে তাদের আরেকটি দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের মানসিক সংকটে তাদের পাশে দাঁড়ানো।

সেই কাজ কয়টি মেডিকেলে হয় তা আমার জানা নেই। কিছুদিন পরপর মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর শোনা যায়, বছর শেষে তারা জায়গা করে নেয় পরিসংখ্যানের উপাত্তে। সেই উপাত্তের বাইরে কত ছেলেমেয়ে মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়ে ডাক্তারি পড়তে এসে অমানবিক কাঠামোর বৃত্তে তুচ্ছ কারনে আটকে আছে- সেই হিসেব কে রাখে! এদের জীবনের নেপথ্যে প্রতিনিয়ত করুণ সুরে বাজতে থাকে “ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে”, কষ্টের সেই বৃত্তভাঙ্গার ক্ষমতা যাদের আছে, তারা কি একটু সক্রিয় হতে পারতেন না?
___________________________

ডা. মাহবুব হোসেন । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়