Ameen Qudir

Published:
2016-12-03 16:24:30 BdST

রোগী পা টেনে ধরে আছি : কাঁপলে হবে রে পাগলা ?


    

 

 

 

ডা. রাজীব হোসাইন সরকার

___________________________

রোগীর পা টেনে ধরে আছি।
স্যার ফিমারের মধ্যে নেইল ঢোকাচ্ছেন। দুইটা পায়ের ফিমার ভাঙা। নেইলের মাথায় হ্যামার দিয়ে বাড়ি দিচ্ছেন আর আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন,
-কি লিখিস?
-স্যার, গল্প।
-কবিতা লিখিস না?
-স্যার, ভাব আসে। অন্ত্যমিল, ছন্দমিল আসেনা।
-বই লিখছিস?
-জ্বি স্যার।
-কি বই?
-স্যার, মানবী মানবী।
-দুইটা মানবী কেন? একটা দিলে দোষ কি?
-স্যার, দোষ নাই।
-স্যার, স্যার বলার দরকার কি? সোজা কথার জবাব সোজা দিলে কি আমাকে অসম্মান করা হবে?
-ন্যা স্যার।

স্যার নেইল ঢুকিয়ে ফেলেছেন। স্ক্রু মারা হবে। ড্রিল দিয়ে হাড়ে ফুটো করা হচ্ছে। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কিসে ক্যারিয়ার গড়বি?
-স্যার, স্কীন ভিডিতে।
-ভালো করছিস। কবি-সাহিত্যিকদের এদিকে আসার দরকার নাই। অর্থোপেডিক কাজ করবে রাফ এন্ড টাফ মানুষরা। তুই কি রাফ-টাফ?
-জ্বি স্যার।
-কিভাবে রাফ-টাফ?
-স্যার, আজ এক রোগীর এটেন্ডেন্সকে ঝাড়ি দিছি। বারবার বিরক্ত করছিল। রুমে ঢুকে আমার প্যাড কলম টানাটানি করে। কাকে যেন মোবাইল নাম্বার লিখে দেয়। মোবাইল আসলে উচ্চস্বরে কথা বলে। আমি ঝাড়ি দিয়ে বলছি, ছয় তলায় তুলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব।

স্যার হাসলেন। পাঁচ সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন,
-সত্যিই ফেলে দিতি?
-জ্বি স্যার দিতাম।
-সত্যিই দিতি?
-জ্বি দিতাম।
-সত্যি দিতি?
-হ, দিতাম। ব্যাটা আমারে চিনে নাই!

স্যার আরেকবার হাসলেন।
কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললেন, তুই স্কীনেই ভালো করবি। ঐ দিকেই যা। চর্ম রোগ, যৌন রোগ নিয়ে ডিল করবি। সার্জারীতে রোগীর সাথে কথা বলার সুযোগ কম। মেডিসিন-মেডিসিনের ব্র্যাঞ্চে অপার কথা বলার সুযোগ। একেকটা রোগী একেকটা একেকটা গল্প। মাঝেমাঝে হাসপাতালে কোন ডিউটি না থাকলেও আসবি। রোগীদের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলবি। একজন মানুষ একমাত্র ডাক্তারকেই নিজের স্ত্রী সহবাসের মত গোপনীয় জিনিসটির কথাও নির্দ্বিধায় বলতে পারে। ডাক্তাররা চাইলেই কোটিকোটি ইউনিক গল্প লিখতে পারে অথচ তারা সাহিত্যে আসেনা। রোগীর গল্প ডাক্তারের মাথায় থাকে। কলমে থাকেনা। কলমে থাকে শুধু ড্রাগ। তারা বই লেখেনা। গন্ডায় গন্ডায় প্রেসক্রিপশন লেখে। কলমের কালিতে শুধু টাকা আসে, গল্প আসেনা।

আমি দীর্ঘসময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম।

মাঝেমাঝে ক্যারিয়ার নিয়ে দোলচালে থাকি। সার্জারী নাকি মেডিসিন।
মাথার উপরে পিতার মত ছায়া হয়ে থাকা বড়বড় দেশবরেণ্য সার্জনরা যখন সন্তানের মত ভেবে কাউন্সেলিং করে, নিজেকে কতটা ক্ষুদ্র লাগে। কত দীর্ঘ পথ অথচ চলছি কত ধীরে।

স্যার দুইটা পায়ে নেইল লাগালেন। স্কীন ক্লোজ হল। ড্রেইন টিউব লাগানো হল। গ্লোভস খুলে OT Note, Post Operative Order লিখে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার বুক পকেট থেকে প্যাড বের করে বললেন,
-স্যার, একটা অটোগ্রাফ দিবেন?

আমি বিস্মিত হলাম।
কত বয়স্ক এবং বরেণ্য সার্জন অথচ কি সাধারণ পাঠকের মতো অটোগ্রাফ চাচ্ছে।

আমি কাপতে শুরু করেছি। স্যার মৃদু ঝাড়িদিয়ে বললেন,
-কাপলে হবে পাগলা?
আমার কাঁপুনি বেড়ে গেল। কাঁপাকাঁপা হাতে কোনরকমে একটা অটোগ্রাফ লিখলাম।
স্যার বলল,
-হাতের লেখা এত গোছানো হলে চলবেনা। লেখকের অটোগ্রাফ আর ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন দুইটা এক কিসিমের হতে হবে।

আমি প্যাডের পাতা ছিড়ে নতুন করে অটোগ্রাফ দিলাম। স্যার যত্ন করে বুক পকেটে রাখলেন।

অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলাম। অটি ড্রেস বদলে ফেললাম। পাঁচ তলা থেকে অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে যেতে দীর্ঘ সিড়িপথ ভাঙার সময় মনে হচ্ছিল- কত দূউউউর পথ চলা বাকি!

_______________________________

 

 

লেখক

ডা.রাজীব হোসাইন সরকার ।
ডিউটি ডাক্তার (নিউরো-সার্জারী)
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়