Ameen Qudir

Published:
2017-02-15 15:32:43 BdST

জাহেদ সাহেব একজন নির্লোভী ডাক্তার :একজন সাধারণ চিকিৎসকের নিত্যজীবন চিত্র


 

দিনের বেশীর ভাগ সময় যার কাটে মানবসেবায় , রোগী সেবায়। তেমন এক লোকসেবীর মুখচ্ছবি।

 

 

ডা. আইনুল হক
__________________________


বিসিএস পাশ করিবার পর জাহেদ ডাক্তারের প্রথম পোষ্টিং হয় তাহার নিজেরই এলাকায়। মনে মনে বেশ পুলকিত হয় সে। যাক, এবার তাহলে নিজের এলাকার মানুষকে মন প্রাণ উজার করিয়া চিকিৎসা দিতে পারিবে সে।

যোগদানের প্রথম দিন হইতেই পরিপাটি পোশাক পড়িয়া সে তাহার জন্য বরাদ্দকৃত টেবিলে আসিয়া বসিয়া পড়িল। জরাজীর্ণ এক রুমে আরেকজন সহকর্মী এবং ভগ্নদশার বাথরুম দেখিয়াও তাহার মনটা ভাঙ্গিয়া যায় নাই। হউক পলেস্তারা চটা রুম তাহাতে কি, রোগীরা তো তাহার নিজের এলাকারই মানুষ।

রোগীরা দল বাধিয়া তাহার কাছে চিকিৎসা লইতে আসিতেছে দেখিয়া তাহার বেশ ভালই লাগিতেছে। বেশ সময় লইয়াই সে রোগী দেখিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু সমস্যা হইল লিখিতে গিয়া। ১ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চি মার্কা ছোট্র টিকিটের উপর ঔষধের নামই তো লিখা যায় না, রোগের বর্ণনা লিখিবে কোথায়!

তবুও শেষমেষ ঔষুধ লিখিতে যাওয়াই জীবনের প্রথম ধাক্কাটা খাইল সে। রোগীর স্বগতোক্তি, "ডাক্তার সাব সরকারি ওষুধ যা আছে তাই লেখেন, কিনা লাগলে নান্টু ডাক্তারের দোকান থিকা নেব নে।"

জাহেদ ডাক্তার সরকারি গৎবাধা কিছু ঔষুধ লিখিতে লিখিতে ভাবিল‚ রোগীর ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের সাথে হার্টের সমস্যার জন্য যে ঔষধের দরকার তাহার তো সরকারী কোন সাপ্লাই নাই। উপযুক্ত চিকিৎসাবিহীন এই রোগীর ভাগ্যে ভবিষ্যতে কি ঘটিতে পারে তাহা কল্পনা করিতেই মানবিক ডাক্তার জাহেদের ভিতরটা মোচড় দিয়া উঠিল।

জাহেদ ডাক্তারের চাকরি জীবন প্রায় তিন মাস হইতে চলিল।

একমাস হইল জাহেদ ডাক্তার সরকারি বাসায় উঠিয়াছে। অবাক হইয়া সে দেখিতে লাগিল, বাসা ভাড়া কর্তন করিবার পর বেতনের যাহা থাকে তাহা দিয়া কোনমতে মাসটা পার করা যায় বটে, কিন্তুু বউ-ছেলেমেয়ের কোন ইচ্ছাই আর পূরণ করা যাইতেছে না। সংসারের দৈন্যদশা কাটাইবার জন্য সে বিকাল বেলা চেম্বার করিতে লাগিল।

প্রায় মাসখানেক চেম্বারে একা একা বসিয়া থাকিবার পর দুই একজন করিয়া তাহার চেম্বার চিনিতে লাগিল। কেউ কেউ আসিয়া বিনা পয়সায় ঘন্টাখানেক ধরিয়া আলাপ করিয়া যায়, কেউবা পঞ্চাশ-ষাট টাকা দেয়, কেউ আবার তাহাও দেয় না। তবুও জাহেদ ডাক্তার হাসি মুখেই সবাইকে দেখিয়া দেয়। তাহার সবচাইতে বেশী কষ্ট লাগে যখন তাহার দেখা বিনা পয়সার রোগীগুলাই শুক্রবারে শহর থেকে আসা বড় ডাক্তার দেখাইয়া আবার তাহার সাথে আলাপ করিতে আসে। বিকাল বেলা বিশ্রাম না লইয়া চেম্বারে বসিয়াও তাহার অভাব মোচন হইতেছে না দেখিয়া জাহেদ ডাক্তার মনে মনে প্রমাদ গুণিতে থাকে। শুধুমাত্র ঔষধ কোম্পানির মামারাই কেবল তাহার চোখে ভবিষ্যতে চেম্বার ভরা রোগীর স্বপ্ন বুনিয়া যায়। ইহাতে অবশ্য জাহেদ ডাক্তারের কপালের ভাজ কিঞ্চিৎ হইলেও কমিয়া যাইবার লক্ষণ বোঝা যায় না।

অবশেষে তাহার জন্য নতুন একটা বুদ্ধি লইয়া হাজির হয় হাস্পাতালের গেটে দুই রুম ভাড়া লইয়া সদ্য চালু হওয়া "জনতা ল্যাব" এর মালিক জগলু মিয়া। সে তাহাকে ঢাকা হইতে "আল্ট্রসোনোর" উপর একটা কোর্স করিতে বলে। স্বরণ করা যাইতে পারে যে, এই জগলু মিয়াই হাস্পাতালের রোগী তাহার ল্যাবে পরীক্ষা করাইয়া জাহেদকে কিছু পার্সেন্টেজ দিতে চাহিয়াছিল। কিন্তুু নীতিবান জাহেদ ডাক্তারকে সে কোনভাবেই তাহার কু প্রস্তাবে রাজী করাইতে না পারিয়া মনক্ষুন্ন হইয়া চলিয়া গিয়াছিল।

যাহাহোক, এইবার কিন্তু জগলু মিয়ার কথাখানা জাহেদ ডাক্তারের মনে ধরিল। সে ভাবিয়া দেখিল, তিন মাসের একখানা "সি-আল্ট্রা" কোর্স করিতে পারিলে রোগীদের উপকারের পাশাপাশি তাহার নিজেরও কিছুটা লাভ হইবে। তাই সে প্রতি শুক্রবারে ঢাকা হইতে ট্রেনিং করিয়া "সি-আল্টা"র উপর একখানা সার্টিফিকেট জোগাড় করিয়া ফেলিল।

আশেপাশের দুই একটা ক্লিনিক হইতে তাহার ডাক আসিতে লাগিল। কিন্তু বিপত্তি বাধিল সময় লইয়া। নীতিবান ডাক্তার জাহেদের পক্ষে অফিস টাইমে বাহিরে গিয়া রোগীর আল্ট্রা করা কোনমতেই সম্ভব নহে। আবার রোগীরাও দেরি না করিয়া অন্যখান হইতে আল্ট্রা করিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল।

চেম্বারে রোগী জমাইতে না পারিয়া জাহেদ ডাক্তার উহা বন্ধ করিয়া বাসাতেই অবস্থান করিতে লাগিল। কখনও বিকাল তিনটায়, কখনও বা সন্ধ্যায়, আবার কখনও রাত দশটায় আলট্রার ডাক আসিতে লাগিল। বিশ্রাম বিসর্জন দিয়া শুধুমাত্র আল্ট্রার জন্যই তাহাকে সর্ব সময় প্রস্তুত থাকিতে দেখা যাইতে লাগিল।

এইভাবে যে সারাজীবন চলিবে না এক বৎসরের মধ্যেই জাহেদ ডাক্তার তাহা বুঝিয়া লইল।

সরকারি বাসা ছাড়িয়া দিয়া জাহেদ ডাক্তার হাস্পাতালের ডরমিটরিতে উঠিয়া পড়িল। দরজা বন্ধ করিয়া সে নিজেকে জগৎ হইতে আলাদা করিয়া ফেলিল। শুরু হইল তাহার জীবনের আরেকটা নতুন অধ্যায় । বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান ভুলিয়া শুধু অফিস, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম বাদে বাকি সময়টা সে পড়াশোনায় আত্বনিয়োগ করিল।

আজ রেজাল্ট বাহির হইয়াছে। জাহেদ ডাক্তার ঢাকায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য মনোনীত হইয়াছে।

এইবার জাহেদ ডাক্তারের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হইতেছে। মনে মনে ভাবে, সে তো এলাকায় থাকিয়াই সম্মান নিয়া স্বচ্ছলভাবে বাচিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু বাস্তবতার কুঠারাঘাত তাহাকে অন্যদিকে ঘুরাইয়া দিল কেন।সে বুঝিল, এখন হইতে আপনকে পর করিয়া তাহাকে এক নতুন সংগ্রামে নামিতে হইবে, সমুদ্রের মাঝে ছোট্ট ডিঙ্গা খানা যেমন করিয়া দুলিতে থাকে, এখন হইতে তাহাকেও সেইরূপ দুলিতে দুলিতে তীর খুজিয়া লইতে হইবে।

আজ জাহেদ ডাক্তারের অফিসের শেষ দিন। দুই বছরের চাকরি জীবনে এখানকার সবাইকে সে অত্যন্ত আপন করিয়া লইয়াছিল। সবার নিকট হইতে বিদায় লইয়া যখন সে হাস্পাতাল ত্যাগ করিল, তখন দেখিল তাহাকে বিদায় দেওয়ার জন্য একখানা ফুল লইয়াও কেউ আগাইয়া আসিল না। অথচ চাকরি জীবনে সে অনেকের বিদায়েরই স্বাক্ষী ছিল, চাদাও দিয়াছে কাহারও কাহারও বিদায় উপলক্ষে। সে বুঝিল, একজন সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তার জাহেদকে মনে রাখার মত তেমন কিছু আসলে নাইও। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে বাড়ির পথে পা বাড়াইল।

ব্যাগ গুছাইয়া জাহেদ ডাক্তার রেডি হইয়া গেল। বিকালের ট্রেনেই তাহাকে ঢাকা যাইতে হইবে। সন্তান কোলে পিছন পিছন আগাইয়া আসিয়াছে তাহার স্ত্রী।

আস্তে আস্তে সে হাটিতে লাগিল আর ফিরিয়া ফিরিয়া বাতাসে দোলানো কচি সন্তানের হাতখানা দেখিতে লাগিল। ধীরে ধীরে ঝাপসা হইয়া যাইতে লাগিল প্রিয়তমা স্ত্রীর মলিন মুখ, বাতাসে নাড়ানো সন্তানের কচি হাত । মোড় ঘুরিতেই পিছন হইতে সে শুনিতে পাইল শিশুর কন্ঠের মায়াবী ডাক - বাববাহ।

দূর্বলচিত্তের ডাক্তার জাহেদের গলা ধরিয়া আসে‚ চোখ ভিজিয়া যায় জলে। পিছন ফিরিয়া তাকাইবার সাহস পায় না সে, দ্রুতবেগে পা বাড়ায় ষ্টেশনের পথ।

__________________________________

লেখক ডা. আইনুল হক

রেসিডেন্ট , নিউরোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়