Ameen Qudir

Published:
2019-02-15 22:15:15 BdST

স্মৃতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ওপারে ভালো থাকুন সংশপ্তক স্বপন ভাই




ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ
___________________________

পার হলো ১৪ফেব্রুয়ারি।
দিনটি ছিলো ভালোবাসা দিবস।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়(বিএসএমএমইউ) পরিবারের জন্য এটি একটি শোকেরও দিবস ছিলো।

গতবছর এই ভালোবাসা দিবসেই আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আমাদের এমন একজন আত্মার আত্মীয়কে হারিয়েছিলাম যিনি নিজগুনে ও সততায় বহুমাত্রিক ধারার একজন সার্থক মানুষ ও বরেন্য একজন চিকিৎসকনেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

যিনি ছিলেন একাধারে একজন শিক্ষানুরাগী অধ্যাপক, একজন গবেষক, একজন সুনামধন্য চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান একজন চিকিৎসক নেতা, একজন সমাজসেবক, সর্বোপরি কর্মী-অন্ত-প্রাণ একজন নেতা যা বর্তমান সময়ে একেবারেই বিরল!

বলছিলাম বিএসএমএমইউ'র সাবেক উপ-উপাচার্য, স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের যুগ্মমহাসচিব, রাজপথের লড়াকু সৈনিক, জীবনব্যাপী বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অবিচল ভ্যানগার্ড প্রফেসর এ এস এম জাকারিয়া স্বপন স্যারের কথা।

তিনি যখন শিক্ষক তখন তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার আবার তিনি যখন একজন নেতা তখন তিনি আমাদের ভালোবাসার বড়ভাই, আমাদের প্রিয় স্বপন ভাই।

আজকের এই দিনে আমরা সেই স্বপন স্যারকে স্মরণ করছি যিনি একজন শিক্ষানুরাগী চিকিৎসা শিক্ষক হিসেবে এদেশের চিকিৎসাশিক্ষা প্রসারে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে যেসব শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক অধ্যাপক এবং বরেন্য চিকিৎসক নেতা নিরলস শ্রম দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম।

আজকের এই দিনে আমরা সেই স্বপন ভাইকে স্মরণ করছি যিনি তাঁর জীবনব্যাপী গণতন্ত্র ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় তাঁর স্বীয় অবস্থান থেকে মরনপণ সংগ্রাম করে গেছেন।
আজকের এই দিনে আমরা সেই স্বপন ভাইকে স্মরণ করছি যিনি ছিলেন নব্বই'র স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামের পুরোধা এবং রাজপথের তেজোদৃপ্ত মিছিলের অগ্রসৈনিক।

একানব্বই'র নির্বাচনের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী'র পদ থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তখন সারাবাংলার লাখকোটি আওয়ামী নেতাকর্মী উদ্বেলিত হয়ে নেত্রী'র এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

সেদিন নেত্রী'র এই সিদ্ধান্ত তুলে নিতে নেত্রী'র সামনে অন্যান্য সিনিয়র নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সারাবাংলার লাখকোটি আওয়ামী নেতাকর্মীর পক্ষে যিনি স্মারকলিপি পাঠ করেছিলেন তিনি আমাদের এই জাকারিয়া স্বপন ভাই। সেই স্বপন ভাইকেই আজ আমরা স্মরণ করছি।

ওয়ান ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাধায়ক সরকার যখন বিনাদোষে মিথ্যা মামলায় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কারান্তরীন করেছিলো তখন সারাদেশের অজস্র উদ্বেলিত নেতাকর্মীর প্রতিবাদের সাথে একাত্ম হয়ে যে কয়েকজন চিকিৎসকনেতা রাজপথে সামিল হয়ে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন আমাদের নেতা স্বপন ভাই ছিলেন তাদের অন্যতম। সেই স্বপন ভাইকেই আজ আমরা স্মরণ করছি।

সেই স্বপন ভাইকেই আজ আমরা স্মরণ করছি 'আপোষ' শব্দটি যার সাথে ছিলো একেবারেই বেমানান!
রাজপথে কিংবা রাজনীতির কোন চোরাগলিতে কখনোই তিনি আপোষ করেননি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে একবিন্দুও বিচ্যূত হননি!

ব্যাক্তিজীবনেও তিনি কারো সাথে আপোষ করেননি!
প্রায় দশবছর যাবৎ দূরারোগ্য ক্যান্সারে ভূগেছেন, একটা মুহুর্তের জন্যও মনোবল হারাননি!
ক্যান্সারের সাথে আপোষ করেননি!
শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে গেছেন অবিচল সাহস আর পাহাড়সম দৃঢ় মনোবল নিয়ে!

উপ-উপাচার্যের রুমে তাঁর যে ছোট্ট একটি রেস্টরুম ছিলো সেখানে কেমোথেরাপি নিয়ে কেমো শেষ হলে বিছানা থেকে উঠে এসে আবার তাঁর চেয়ারে বসে অফিসিয়াল কাজ করেছেন!

যারা শুধু ঘটনাটি পড়লেন তারা হয়তো বুঝবেন না যে কতোটা মনোবল আর জীবনীশক্তি থাকলে একজন মৃত্যূপথযাত্রী ক্যান্সারের রুগি এতোটা অদম্য হতে পারেন!
যারা একবার কেমোথেরাপি নিয়েছেন তারা হয়তো বুঝবেন কেমোথেরাপি কতোটা কষ্টের এবং তা শরীরকে তাৎক্ষণিকভাবে কতোটা দুর্বল করে দেয়!

আমাদের কোন বরেন্য চিকিৎসকই তাদের সারাজীবনে এমন দৃঢ় মনোবলের কোন রুগি পেয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই।
স্বপন ভাইয়ের চিকিৎসক অধ্যাপক সেলিমুর রহমান স্যার নিজেও এমনটি বলেছেন আজকের স্মরণসভায়, স্বপন ভাইয়ের স্মরণে আয়োজিত আজকের স্মরণসভায়।

মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যে সৈনিক মৃত্যু পর্যন্ত লড়ে যায় সেই তো সংশপ্তক!
আমাদের প্রিয় স্বপন ভাই এই সাহস ও মনোবল দেখাতে পেরেছিলেন কারন তিনি ছিলেন একজন সংশপ্তক!

আমাদের বিদগ্ধ সিনিয়র চিকিৎসক অধ্যাপকেরা আরো বেশী করে বলতে পারবেন চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণা এবং বিএসএমএমইউ'র অগ্রযাত্রায় জাকারিয়া স্বপন স্যারের অবদানের কথা।

চিকিৎসক রাজনীতির দিকপাল আমাদের বরেন্য প্রবীণ চিকিৎসক নেতারা তাদের একজন সতীর্থ সহযোদ্ধা হিসেবে রাজনীতিতে জাকারিয়া স্বপন ভাইয়ের ত্যাগ ও অবদানের ইতিহাস আরো বেশী বেশী করে বলতে পারবেন।

আমরা যারা অনুজ চিকিৎসক যারা মাত্র ষোল সতেরো বছর তাঁর সাহচর্য ও আনুকূল্য পেয়েছি তাদের কাছেই স্বপন ভাই অসংখ্য স্নেহ-ভালোবাসা মথিত স্মৃতির এক বিশাল আধার!
যেসব সিনিয়রেরা আরো বেশী বেশী সময় তার সাহচর্য পেয়েছেন তারা না জানি কতো ভাগ্যবান!

একটা ব্যাক্তিগত অনুভূতির কথা না বলে পারছি না।
রাজনৈতিক কারনে বা অন্যকোন কারনে বা শুধুমাত্র সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য যখনই তাঁর রুমে গিয়েছি আপন ছোটভাইয়ের মতো কাছে ডেকে নিয়েছেন!

প্রায়ই তাঁর রুমে যেমন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের বিগশট নেতাদের আসাযাওয়া ছিলো তেমনি ছিলো সচিবালয় মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আসাযাওয়া।

তাঁর রুমে থাকাকালীন অবস্থায় যদি এই ধরনের বিগশট কোন নেতা বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতো তাহলে তাদের সাথে তিনি এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতেন, এমন এমন বিশেষণে ও অভিধায় ভূষিত করে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন যার যোগ্য আমি নই!
তাই অনেকসময় আড়ষ্ট হয়ে কুকড়ে যেতাম!

ঘটনাটি শেয়ার করলাম নিজেকে উপস্থাপনের জন্য নয়!
ঘটনাটি শেয়ার করলাম কারন তিনি তাঁর সকল কর্মীকেই এভাবেই অন্যদের সামনে তুলে ধরতেন, এভাবেই ওয়োন করতেন!

তিনি কর্মী আর নেতার মাঝে কোন ডিমার্কেটিং লাইন রাখতেননা!
তিনি কর্মীকে কখনোই কর্মী মনে করতেন না!
তিনি কর্মীকে মনে করতেন তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা!
এটাই তার সার্থকতা।

কোন রাজনৈতিক কর্মী তার বিপদ-আপদ বা সঙ্কটের সময় স্বপন ভাইয়ের সাহায্য চেয়ে পাননি এমন উদাহরন বোধ করি তাঁর ঘোরতর সমালোচকও দিতে পারবে না!

শুধু মুখের কথায় আশ্বাস দিয়ে কিংবা মোবাইলে টেলিফোনে সহমর্মিতা জানিয়েই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করতেন না বরং নিজে স্বশরীরে ছুটে যেতেন সেই বিপদগ্রস্ত কর্মীর কাছে তাকে বিপদমুক্ত করতে!
এমন বহু উদাহরন আছে।

আজ আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র চিকিৎসকরা যখনই কোন সঙ্কটে পড়ি তখনই বারবার একজন জাকারিয়া স্বপনের অভাব প্রকটভাবে অনুভব করি।
শুধু আমরা কেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময়ে যারা স্বপন ভাইয়ের বিরোধিতা করেছিলো তারাও আজ অকপটে একজন স্বপন ভাইয়ের অভাব স্বীকার করে নেয়!

এটাই স্বপন ভাইয়ের সার্থকতা!
চিরবিদায় নেওয়ার পরও শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাইকেই স্বপন ভাই তাঁর অভাব অনুভব করাতে পেরেছেন!
এমন কয়জন পারে!?

চরমতম দুঃখ এবং হতাশার বিষয় হলো তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি মানসিক শান্তি নিয়ে কাটাতে পারেননি!
যে বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি নিজের ঘর আর নিজের পরিবার মনে করতেন,
যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অপরাপর অন্য অনেকের মতো তাঁরও অগ্রনী ভূমিকা ছিলো সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শেষদিকে এসে তাঁর সাথে একরকম বিমাতাসুলভ আচরন করেছে এবং তাকে বারংবার নিগৃহীত করেছে বললে মোটেও অত্যূক্তি হবে না!

তবে যারা একসময় তার বিররোধিতা করেছিলো তারাও আজ তাঁর বিরোধিতার জন্য ভিতরে ভিতরে অনুতাপ বোধ করে!
এটাই স্বপন ভাইয়ের সার্থকতা!

আমরা চাই আমাদের আর কোন প্রিয় শিক্ষক আর কোন প্রিয় নেতা আর কোন মুজিবাদর্শের সৈনিক যেন তার জীবদ্দশায় এমন নিগৃহের শিকার না হন যে জন্য তার প্রয়াণের পর আমাদেরকে অনুতাপ করতে হয়!

পরিশেষে প্রিয় নেতা স্বপন ভাই, প্রিয় শিক্ষক স্বপন স্যারের বিদেহী আত্মার বেহেশত কামনা করে এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সুগভীর সমবেদনা জানিয়ে শেষ করছি।
। ওপারে ভালো থাকুন স্বপন ভাই।
______________________

ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ।
সহ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ,স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক পরিষদ, বিএসএমএমইউ।
Doctor ,t Bangabandhu Sheikh Mujib Medical University
Former Secretary General বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ শাখা ,দিনাজপুর।
Studied MBBS. at Dinajpur Medical College, Dinajpur

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়