Ameen Qudir

Published:
2016-12-19 15:31:00 BdST

উপকারী ডাক্তারের গায়ের ছাল থাকে না


 

মাঠপর্যায়ে ডাক্তারী বিড়ম্বনার সত্য অথচ প্রতিকী ছবি। কাশ্মীরের এই মন্ত্রী এক চিকিৎসককে নিগ্রহ করে আলোচিত হয়েছিলেন।

 

______________________________

ডা. আইনুল হক
_________________________


উপকারী গাছের ছাল থাকে না।
ঘটনা -১

২৭ তম বিসিএসে আমার প্রথম পোষ্টিং হয় নিজের এলাকারই ইউনিয়ন সাব সেন্টারে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার স্বল্পতা থাকায় আমার মত আরও চারজন তরুণ ডাক্তারকে টিএইচএ স্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই রেখে দেন কাজের সুবিধার জন্য। নিজের এলাকা, চারপাশে চেনা মানুষজন - ভালই কাটছিল চাকরির দিনগুলো। এরই মধ্যে একদিন কয়েকজন লোক তাদের বাবার পেনশনের টাকা তোলার জন্য ফাকা ফর্ম নিয়ে আসে আমার সিগনেচার নেওয়ার জন্য। আমি তা যথাযথভাবে পূরণ করে পরিচয় পত্রসহ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে আগে সত্যায়িত করে নিয়ে আসতে বলি। আমাকে জানানো হয় তারা নাকি এমপির লোক। সত্য মিথ্যা জানি না, এর কিছুদিন পরেই নতুন চাকরির নয় মাসের মাথায় স্ট্যান্ড রিলিজ খাই। বিষয়টা নিয়ে সেখানকার বিএমএ নেতার সাথে দেখা করতে গেলে যে অভিজ্ঞতা হয় তা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।

ঘটনা ২

কোর্সের মাঝখানে ডেপুটেশন শেষ হওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদান করি। বেশ পরিচিত এলাকার এক বড় ভাই (!) ওখানে চাকরি করেন। উনাকে বললাম যে আমার ফেজ এ ফাইনাল পরীক্ষার আর মাস দুয়েক সময় আছে। তাই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোষ্টিং দিলে পরীক্ষাটা ভালভাবে দিতে পারব। উনি বললেন কোন অসুবিধা হবে না। শুকনো কথায় যে চিড়ে ভিজে না সেটা টের পেলাম যখন দেখলাম আমাকে পদায়ন করা হয়েছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য কার্যালয়ে।


কি আর করা। এবার ধর্না দিলাম সেখানে। বললাম আমাকে শহরের মধ্যে পোষ্টিং দিতে। কারণ উপজেলা লেভেলে বিদ্যুৎ থাকেনা তাই ঠিকমতো পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে পারব না। ফলস্বরূপ আমাকে কোন কোন খাতে কত দিতে হবে তার ফর্দ শোনানোর পর অর্থ এবং ইচ্ছা কোনটাই আর বাকি থাকল না। আল্লাহর উপর ভরসা করে বিদায় হলাম। এক সপ্তাহ পর দেখলাম আমার পদায়ন হয়েছে সর্বহারা অধ্যুষিত এক প্রত্যন্ত এলাকায়।

জয়েন করলাম। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাস্পাতালের ডাক্তার আমি, আর একজন মেডিকেল অফিসার এবং টিএইচএ স্যার। অর্জিত ছুটি নিতে চাইলাম। ডাক্তার না থাকায় স্যার রাজী হলেন না। এরই মধ্যে ওই মেডিকেল অফিসার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বদলির অর্ডার নিয়ে আসল, টিএইচএ স্যারের সিগনেচার না করে উপায় ছিল না।


এখন আমি একাই ইনডোর, আউটডোর এবং ইমার্জেন্সি সামলাই। রাতদিন গরু খাটুনি খাটি। পরীক্ষা লাটে উঠে গেছে অনেক আগেই। একদিন ইনডোর রাউন্ড শেষে কেবলমাত্র বিশ্রাম নিচ্ছি, তখন একজন মহিলা তার ১২/১৩ বছরের মেয়ের জন্ম নিবন্ধন কাগজ নিয়ে আসে সত্যায়িত করে দেওয়ার জন্য। বললাম ওর বয়স তো ১৮ হয় নাই। সে বলল তাকে অমুক নেতায় পাঠাইছে। ঠিক আছে, আগে চেয়ারম্যান এর স্বাক্ষর নিয়ে আসেন তারপর আমি দেব। প্রায় আধাঘন্টা পর কয়েকজন সান্ডা পান্ডা নিয়ে সেই নেতা অনুমতি ছাড়াই আমার রুমে হুড়মুড়্ করে ঢুকে আমাকে শাসাতে থাকে, আমার ছবি তোলে এবং ভবিষ্যতে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়।

আমি আসলে কাউকে নালিশ করিনি। কারণ আমি জানি নালিশ করে লাভ নেই। সিগনেচার করিনি আরও বড় আইনি ঝামেলা এড়াতে। সিগনেচার করলে আর ওই মেয়েটার বিয়ে হলে বাল্য বিবাহের একটা উটকো ঝামেলা হয়তো পোহাতে হত। এইজন্যই আগে চেয়ারম্যান এর সিগনেচার চেয়েছি। এই ঘটনার কিছুদিন আগে সেখানে প্রশাসনের লোকজন বাল্য বিবাহের অপরাধে কয়েকজনকে আটক করে।


যাইহোক, আমার অভিজ্ঞতায় বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষই সাধারণ। তবে এরা হুজুগে এবং নিজস্ব বিচার বুদ্ধি বহির্ভূত, হাসপাতালের যে কোন অব্যবস্থাপনার জন্য এরা ডাক্তারদের দোষারোপ করে । ডাক্তাররা ঠিকমতো কাউন্সেলিং করলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যাবে।

পরিশেষে বলতে চাই‚ ডাক্তাররা দরদ এবং সহানুভূতি দিয়েই রোগীদের চিকিৎসা দিবেন তবে অবশ্যই নিজেকে সেভ করে। যদি নিজেকে শতভাগ উজার করে দিয়ে কাজ করে যান তবে দিনশেষে আপনি গুরুজনদের সেই কথাকেই প্রমাণ করবেন - '' উপকারী গাছের ছাল থাকে না।"

ধন্যবাদ । ______________________________

 

 


লেখক ডা. আইনুল হক

রেসিডেন্ট , নিউরোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়