Ameen Qudir
Published:2017-10-06 03:30:06 BdST
আজ কোজাগরী পূর্ণিমা
ডা. তারিক রেজা আলী
__________________________________
আজ কোজাগরী পূর্ণিমাতিথি। বিকেল থেকেই দেখা যাচ্ছে পূর্ণ চন্দ্র। আশ্বিনের এই সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ী ফিরছিল চন্দনা। মন- মেজাজ খুবই খারাপ। অফিসে বস সবার সামনে বলে বসলেন সঠিক সময়ে চন্দনা ই-মেইলের জবাব না দেওয়াতে এক বিরাট অর্ডার বাতিল হয়েছে তাদের। চন্দনার কারণে কোম্পানি বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন। কোন দিন যা হয় না, বেশ কিছু কটু কথা শুনিয়ে দিলেন চন্দনাকে। জোৎস্নার আলো তাই চন্দনাকে স্পর্শ করছে না। তার মেজাজ খারাপের আরেক কারণ, সে তার স্বভাব মতো কোন জবাব দিতে পারে নি। নীরবে হজম করেছে সব অপমান। কেন করলো? কেন সে বলতে পারলো না, সে দায়ী নয়, এখানে তার কোন ভুল নেই?
ছোট বেলা থেকেই চন্দনা এমন কোমল স্বভাবের ছিল। আশেপাশের সবার আদর পেয়ে, সবার ভালবাসা পেয়ে বড় হতে হতে তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল তাকে সব জায়গায় ভাল থাকতে হবে। সে চাইতো সবাই তাকে ভাল বলুক। কিশোরী বয়সে সে যা চাইতো, আরেকটু বড় হয়ে শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ পার হয়ে নিজের জগৎ তৈরি করতে করতে তা আরো ব্যাপক আকারে রূপ নিতে লাগলো। তার প্রার্থনা তখন ছিল সে বড় হয়ে ভাল অফিসে ভাল কাজ করবে অথবা অধ্যাপনা করবে, সে ভাল বৌ হবে, ভাল মা হবে, নিজের আর শ্বশুরবাড়ীর সবাই তাকে ভাল বলবে। নিজেকে আরও ভালো করার, নিখুঁত করার প্রতিযোগিতায় সে মগ্ন থাকতো।
একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ওর দু'বছরের বড় ভাই খুব চঞ্চল আর দুষ্টু ছিল। বাসায় ভাইয়ের সাথে ও খেলতো, ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় সাথে থাকতো। ভাইয়ের সাথে খেলার মাঠেও যেতো পাড়ার ফুটবল খেলা দেখতে। একদিন ছাদে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ভাইয়ের মাথা অনেকখানি কেটে গেলো। ঘরে ফিরে এলে বাবা চন্দনাকে অকারণে বকলেন। যেন সব দোষ ওর। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। সবার অলক্ষ্যে বাড়ী থেকে বের হয়ে গেল। এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে দু-তিন ঘন্টা পর দেখলো, তার যাবার আসলে কোন জায়গা নেই। সন্ধ্যার পর বাড়ী ফিরে এলো সে। না, সে যে ছিল না, কোন আলোড়ন ফেলেনি তা। আশ্চর্য হয়ে চন্দনা লক্ষ্য করলো, তার বড়বোনকে রান্না করা শিখাচ্ছে মা। একথা ওকথা বলে হাসছে দুজনেই। ভাই শুয়ে আছে পাশের ঘরে। মা তাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করলেন না। বাবা শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, "কোথায় গিয়েছিলে?" খুবই অবাক হয়ে চন্দনা শুনলো তার নিজের উত্তর। কে যেন তার ভিতর থেকে বলে উঠলো, "কয়েকটা খাতা আর বই কিনতে গিয়েছিলাম বাবা!" বড় হওয়ার পর সে বহুদিন ভেবেছে, কেন এমনটা হলো, তার তো রাগ করা উচিৎ ছিল, চিৎকার করা উচিৎ ছিল, সবার ভুল ভাঙিয়ে বলা উচিৎ ছিল, সে নির্দোষ, তাকে শুধু শুধু শাস্তি পেতে হয়েছে। সে কেন এই কাজটি করতে পারলো না। এখানেও কি তার ভাল থাকার, সব কিছু বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়ার অবচেতন মন কাজ করেছে?
শরতের এই সন্ধ্যায়, অফিস থেকে ফিরে চন্দনা এসব কথা মনে করছিল। খুব মন খারাপ লাগছিল। অন্ধকার ঘরে একা বসে ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফোন করেছেন ওর খুব প্রিয় একজন মানুষ, বাবার বন্ধু। ও ফোন ধরে দৌঁড়ে ছাদে গেল। "কেমন আছিস মা?"...কেঁদে ফেললো, সব খুলে বললো। চাচা বললেন," অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করবি না"। ও আকাশের দিকে তাকালো। বাহ, কি সুন্দর জোৎস্না আজ! নারকেল গাছগুলোর পাতা চাঁদের আলোয় যেন ঝলমল করছে। প্রকৃতি কখনো বঞ্চনা করেনা।
শান্ত স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো চন্দনা। আর নয়। এবার সে প্রতিবাদ করবেই। দরকার হলে চাকুরী ছেড়ে দেবে, কিন্তু আর সহ্য করবে না এই অকারণ অপমান।
_________________________________
ডা. তারিক রেজা আলী । সহকারী অধ্যাপক। রেটিনা। বিএসএমএমইউ।
আপনার মতামত দিন: