Ameen Qudir

Published:
2017-08-11 06:14:41 BdST

মৃতের আত্মীয়রা এসে গেছেন, জেনে গেছেন চোখ সংগ্রহের খবর


 

 

 

 

ডা. তারিক রেজা আলী

__________________________________


মৃত্যুকে আমি ভয় পাই, নি:সন্দেহে অনেক অনেক ভয় পাই। মৃত্যুর পর কি হবে এ চিন্তা আর সবার মতো আমাকেও গ্রাস করে, তীব্র ভাবে আচ্ছন্ন করে প্রায়শই। জাগতিক নিয়মে আবার দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই, ভুলে থাকি মৃত্যুকে। 'জন্মিলে মরিতে হইবে' এই আপ্ত বাক্য খুব বেশীক্ষণ আছর করে থাকে না মগজে। এটাই জগতের নিয়ম।

 

ইন্টার্ণী করি যখন, ১৯৯২-৯৩ সালে, শিশু বিভাগে নাইট ডিউটি ছিল এক রাতে। ঐ রাতের কথা আমি জীবনেও ভুলতে পারব না, ভয়ংকর বিভীষিকাময় সেই রাতে সাত সাত জন ফুলের মত শিশু মৃত্যুবরণ করেছিল। একজন কে রিসাসিটেশনের ব্যর্থ চেষ্টা করে ডেথ ডিক্লেয়ার করার মত খারাপ একটা কাজ করতে না করতেই আরেক বেডে তলব। সিনিয়র সিএ রেজিস্ট্রার রা ছিলেন কি না মনে নেই, শুধু মনে আছে কখন ভোর হবে, কখন বের হব আমি এ মৃত্যুপুরী থেকে এ চিন্তা করতে করতে পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। সাত জন শিশুর মৃত্যু আমার হাতে, ভাবতেই ইচ্ছে হচ্ছিল নীচে ঝাঁপ দেই অথবা দেয়ালে মাথা ঠুকি।


এর কিছুদিন পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে বেওয়ারিশ এক মৃতদেহ থেকে চোখ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম সন্ধানী কর্মী হিসাবে। সেবার মৃত ব্যক্তিকে দেখে ভয় পাইনি। অস্বস্তি ছিল, নিজ হাতে (চোখ) কর্ণিয়া সংগ্রহ সেই প্রথম। একটু পরে পড়লাম বিপদে। মৃতের আত্মীয়রা এসে গেছেন, জেনে গেছেন তারা চোখ সংগ্রহের খবর। ঘেরাও করে ফেলা হলো আমাকে। কি ভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কর্মচারীরা আমাকে সুস্থদেহে বের করে আনলেন, সে আরেক ইতিহাস।
আরো পরে মারা গেলেন কত প্রিয় মানুষ। পিতা, পিতৃব্য কয়েকজন, নানা, নানী, শ্বশুর-শাশুড়ি। সব শেষে গত শুক্রবার মারা গেলেন আমার বোন নাসরীন আফরোজ মনিকার শাশুড়ি। বোনের স্বামী, তাঁর পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে ইমতিয়াজ কামাল হজ্বের উদ্দেশ্যে এখন মক্কায়। তাঁর একমাত্র বোন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। মনিকার শ্বশুর সাহেবের শরীরও ভাল যাচ্ছে না। সংসার, চাকুরী সব নিয়ে মনিকার ত্রাহি অবস্থা। শুক্রবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে যখন চাচা-চাচী দুজনকে দেখলাম, চাচীকে অত অসুস্থ মনে হয় নি আমার। সারা দিন ছিলাম তাঁর সাথে। বিকাল চারটায় তাঁকে বলে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেলাম। ফিরে দেখি চাচী খুবই অসুস্থ। তক্ষুনি অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হলো। এ্যাম্বুলেন্সে যখন উঠালাম, আমি বুঝতে পারছিলাম ওনার শরীর ভাল না, কিন্তু মারা যে যাবেন মন বলে নি। কারন তিনি একেবারেই সজ্ঞানে ছিলেন। কিন্তু আরেক হাসপাতালে যাওয়ার আগেই আমার বোনের হাত ধরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমার চাচীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধান্জলি। তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করছি।
এই মৃত্যুর পর আমার চিন্তা ভাবনা যেন অন্য লয়ে বইছে। মৃত্যু কি জিনিস, কোথায় যান সবাই, আমি নিজে কোথায় যাব, সব পূর্ব পুরুষ কি অপেক্ষা করছেন আমার জন্য, আমি কি চিনব তাঁদের, তাঁরা কি আমাকে চিনবেন, এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। অন্য সময়ের সাথে পার্থক্য হচ্ছে, চিন্তাটা সারাক্ষণই ঘুরছে, ছেড়ে যাচ্ছে না। কিছু লেখাপড়ার চেষ্টা করলাম, খুব যে দাঁত বসাতে পেরেছি তা নয়, তবে পরকালে বিশ্বাস আরো পোক্ত হয়েছে। বুঝতে শিখেছি আসলেই মৃত্যুটা ভয়ংকর কিছু নয়, এটা সত্যিই আরেক জগতের সাথে এক আড়াল মাত্র। একটা ঠুনকো দেয়াল, যেটা সরে গেলেই দেখা যাবে দিগন্ত বিস্তৃত ঘাসে আচ্ছাদিত ভূমি, যেখানে আছে শান্তিময় শত প্রাণের অবস্থান। সেখানে জীবন যেহেতু অনন্তকালের জন্য, পাথেয় তো কিছু নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু তার পূর্ব পর্যন্ত? যতক্ষন এ জগতে জীবন নিয়ে চলছি, ঘুরছি, এখানেও পালন করতে হবে সকল দায়িত্ব। এ পর্যায়ে পড়লাম ফেসবুকেই ২০১৫ সালের একটা পোষ্ট। "অনুবাদকের আড্ডা" এই পেজে পেলাম কিছু হৃদয় ছোঁয়া কথা।
--------------------------------------------
মৃত্যু, অমরত্ব নিয়ে অসাধারণ কিছু কথা। পরম শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের কাছ থেকে শেখা কথাগুলো নিয়ে লিখেছিলেন তার মেয়ে সাশা সেগান। আর সেটার অনুবাদ করলেন শোভন রেজা এবং আদৃতা হাবীব।
.
অনূদিত প্রবন্ধের লিংক -
https://onubadokderadda.com/mortality_and_immortality_sasha…/
.
নির্বাচিত অংশ -
// “ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কিন্তু জীবিত! এটা কিন্তু মোটেও সাধারণ কিছু নয়” তাঁরা আমাকে বললেন, “একটা মানুষ জন্ম নেয়ার রাস্তায় যে কতগুলো বাঁক আছে, সেই অসীম সম্ভাবনার কথা যখন চিন্তা করবে, তখন এই জীবনের জন্যে আপনাআপনিই কৃতজ্ঞতা অনুভব করবে। ভাবো, অসীম সংখ্যক সেই বিকল্প মহাবিশ্বগুলোর কথা, যেখানে হয়তো তোমার প্র-প্র-পিতামাতার কখনো দেখাই হয়নি। আর সে কারণে হয়তো তোমার অস্তিত্বই নেই!
.
তারপর ভাবো, তুমি এমন একটা গ্রহে বিবর্তিত হয়েছো যেখানে তুমি শ্বাস নিতে পারছো, যার পানি পান করতে পারছো, আর এর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র থেকে উষ্ণতা পাচ্ছো! ডিএনএ জিনিসটার মাধ্যমে কিন্তু তুমি অনেক অনেক প্রজন্মের সাথে সংযুক্ত। আরো বড় ব্যাপার হচ্ছে, তোমার শরীরের প্রতিটি কোষ একটা নক্ষত্রের অন্তরে তৈরি হয়েছিলো। “আমরা নক্ষত্রের টুকরো দিয়েই তৈরি” বাবার এই কথাটা খুব বিখ্যাত হয়েছিলো। এবং তিনি আমাকে এই কথাটার সত্যতা অনুভব করিয়েছিলেন। //

_________________________________

ডা. তারিক রেজা আলী । সহকারী অধ্যাপক। রেটিনা। বিএসএমএমইউ।

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়