Ameen Qudir

Published:
2017-05-28 00:29:00 BdST

একজন চিকিৎসক কি হত্যাকারী? জাতির কাছে কিংবদন্তী ডাক্তার আব্দুল্লাহর প্রশ্ন



অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ

________________________________________

 

 

 

দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এর পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একপেশে সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগ আনছেন চিকিৎসকেরা। আসলেই কি হাসপাতালে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে সব ক্ষেত্রে চিকিৎসকই দায়ী? একজন চিকিৎসক কি হত্যাকারী? তিনি কি ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে অভিযুক্ত হবেন? চিকিৎসক, চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং আপামর জনগণ—সবার মধ্যে আজ এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।

প্রথমেই জানা যাক, চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন রোগীর মৃত্যুর কী কারণ থাকতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগের স্বাভাবিক পরিণতিতে রোগীর মৃত্যু হয়। এক রোগের চিকিৎসা চলাকালীন হঠাৎ অন্য কোনো প্রাণঘাতী রোগে, যেমন হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েও মৃত্যু হতে পারে। চিকিৎসা কিংবা অপারেশনের জটিলতা বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও রোগীর মৃত্যু হতে পারে। ভুল চিকিৎসা বা অবহেলায়ও মৃত্যু ঘটা অসম্ভব নয়।

এ ছাড়া উপযুক্ত চিকিৎসা উপকরণ বা ওষুধের অভাব, দক্ষ চিকিৎসক বা নার্সের অভাব, রোগীর ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ মেটানোর অসামর্থ্য, রোগীর আত্মীয়স্বজনের অনাগ্রহ বা অবহেলাও এ ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে। অথচ কোনো রোগীর মৃত্যু হলে প্রায়ই চিকিৎসককে দায়ী করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন রোগীরও মৃত্যু হবে না, এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না, পৃথিবীর কোথাও না। অনেক রোগ পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়, যেমন ক্যানসার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেলে, লিভার, কিডনি বা হৃৎপিণ্ড নষ্ট হয়ে গেলে রোগী মারা যায়।

চিকিৎসায় ভুল হতেই পারে। অনেক উন্নত দেশের হাসপাতালেও চিকিৎসকদের অনিচ্ছাকৃত ভুলে রোগী মারা যায়। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করে, বিপুল অঙ্কের অর্থ জরিমানা করা হয়, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। তাই বলে রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসককে দায়ী করে ভাঙচুর করা হয় না।

অথচ আমাদের দেশে মৃত্যু হলেই ঢালাওভাবে চিকিৎসককে দায়ী করা হয়, চিহ্নিত করা হয় হত্যাকারী হিসেবে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলা হয়, যদিও চিকিৎসকের এই ‘ভুল’ নির্ণয় করার কোনো যোগ্যতা তাদের নেই। এমন অনুমাননির্ভর, আবেগপ্রসূত, উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হয় ভাঙচুর, গালাগাল, মারধর, মামলা-মোকদ্দমা। কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার, রিমান্ডে নেওয়া আর নাজেহাল করা হয়। এসব ঘটনা ফলাও করে পত্রিকায় প্রচার করা হয়, যার বেশির ভাগই খণ্ডিত সত্য।

একজন চিকিৎসক সব সময় চেষ্টা করেন রোগীকে সুস্থ করতে, যা তাঁর পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব। কেউ যদি এ দায়িত্ব পালন না করেন, তার জন্য চিকিৎসক সমাজকে ঢালাওভাবে দায়ী করা যায় না। গুটি কয়েক চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুলের জন্য সব চিকিৎসককে দায়ী না করে চিকিৎসাব্যবস্থার মূল সমস্যাগুলোয় দৃষ্টি দেওয়া দরকার। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই রোগীও বেশি। সে তুলনায় দক্ষ লোকবল ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল, ভালো চিকিৎসক তৈরির পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। যত্রতত্র মেডিকেল কলেজের অনুমোদন, নোংরা রাজনৈতিক দলাদলি ও দুর্নীতি ভালো চিকিৎসক তৈরি বাধাগ্রস্ত করছে। এত কিছুর মধ্যেও অনেক চিকিৎসক চেষ্টা করেন রোগীকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, সাধারণ মানুষ নানাভাবে হয়রানি ও অবিচারের শিকার হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার মিলছে না। দেশে আইন, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা আছে, ভুক্তভোগীরা সুফল পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি চিকিৎসাক্ষেত্রেও বিরাজমান। কারণ, তারা এ সমাজেরই অংশ। অবহেলা আর অনিয়মের ব্যাধি ক্যানসারের মতো সমাজে বাসা বেঁধেছে। শুধু একটি পেশার মানুষকে দোষ দিয়ে মুক্তি কি সম্ভব?

এ কথা সত্য, অবহেলার সব অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। চিকিৎসাক্ষেত্রেও অনিয়ম হচ্ছে, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার ঘটনা ঘটছে, এর বেশির ভাগই ঘটছে অনুমোদনহীন যত্রতত্র গড়ে ওঠা হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। আবার নামীদামি হাসপাতালেও এ ধরনের অঘটন ঘটছে। অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা বিএমডিসির রয়েছে। ক্লিনিক আর হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি বিভাগ রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অভিযোগ আমলে না নেওয়ার প্রবণতা আর বিচার না হওয়ার প্রথা এসব অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এতে প্রকৃত অন্যায়কারীর পাশাপাশি ঢালাওভাবে কর্তব্যপরায়ণ চিকিৎসকেরাও অপমান ও হামলার শিকার হচ্ছেন।

এর সমাধানকল্পে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ জন্য চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ভূমিকাই মুখ্য। রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ এবং তাদের সঙ্গে মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের আরও আন্তরিক হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে চিকিৎসা-শিক্ষাক্রমে এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। উন্নত বিশ্বে চিকিৎসাশিক্ষার শুরুতেই শেখানো হয় রোগীদের সঙ্গে পেশাগত সুসম্পর্ক রচনার কৌশল। রোগীর মৃত্যু হলে স্বজনদের প্রতি কীভাবে সহমর্মী হতে হয়, সে শিক্ষাও দেওয়া হয়। আমাদের কারিকুলামে এ বিষয়টি অবহেলিত।

মনে রাখা উচিত, কিছু চিকিৎসকের ভুল বা অবহেলার জন্য যেমন সব চিকিৎসককে দায়ী করা যায় না, তেমনি দু-একজন রোগী বা তার আত্মীয়স্বজনের অপকর্মের জন্য অন্যান্য রোগীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে ধর্মঘট করাও অনৈতিক। উচ্ছৃঙ্খল কিছু লোকের আচরণে অন্য রোগীকে জিম্মি করা আর দুর্ভোগ বাড়ানো অমানবিক। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসাসেবা অন্য পেশার মতো নয়, এর সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যু জড়িত। স্বজনের মৃত্যুতে আবেগপ্রবণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে মানবিক আচরণ না পেলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবেই।

রোগী মারা গেলে অরাজকতা না করে কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। চিকিৎসকের পাশাপাশি রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনকেও নিজেদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অসহিষ্ণু হয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ভালো সেবা আদায় করা অসম্ভব। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের কারণে কোনো হাসপাতালের সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থা বিঘ্নিত করা কারও কাম্য নয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিকিৎসক-রোগী ছাড়াও চিকিৎসক-সাংবাদিক সম্পর্কটিও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। গণমাধ্যমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, চিকিৎসাক্ষেত্রে যেসব সাফল্য রয়েছে, তাকে উপেক্ষা করে শুধু গুটি কয়েক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ফলাও করে প্রচার করার চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। চিকিৎসাক্ষেত্রে বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এর ভালো দিকগুলো তুলে ধরার দায়িত্ব মিডিয়ার রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেগুলো সঠিকভাবে প্রচার করা দরকার। বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসাসহ শত শত অপারেশন সফলভাবে করা হচ্ছে। কিডনি প্রতিস্থাপন, হৃদ্‌রোগের বাইপাসসহ রিং পরানো, বোনম্যারো প্রতিস্থাপন, নিউরোসার্জারি ইত্যাদি আধুনিক চিকিৎসা উন্নত দেশের মতোই হচ্ছে। এসব বিষয়ে রিপোর্ট করা দরকার। আমাদের দেশে ভালো মানের চিকিৎসক আছেন। তাঁরা রোগীর অধিকার এবং নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু সর্বদা যদি দোষ দেওয়া হয়, ভালো কাজের স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তবে কেউ ভালো কাজ করতে উৎসাহী হবেন না। চিকিৎসক ও রোগীর পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়, এমন নেতিবাচক খবর প্রচারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অতিপ্রচার যেন না করা হয়, সে দিকটাও দেখতে হবে।

চিকিৎসকেরা অবশ্যই তাঁদের পেশাদারি বজায় রাখবেন, মানবিকতা ও সুশিক্ষার পরিচয় দেবেন। অন্যদিকে হাসপাতালে যারা সেবা নিতে আসবে, তারাও চিকিৎসকদের সীমাবদ্ধতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকবে, হাসপাতালে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি থেকে বিরত থাকবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

____________________________

 

লেখক : বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তী ডাক্তার। অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ,

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত।

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়