Ameen Qudir

Published:
2017-04-24 15:49:16 BdST

একজন লাকী আখন্দ ও তাঁর চিকিৎসা নিয়ে কিছু কথা


 



ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
_____________________________

লাকী আখন্দের চিকিৎসা নিয়ে একটা কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে - অর্থের অভাবে তার সুচিকিৎসা হয়নি। কথাটি সত্য নয়।

লাকী আখন্দ দুরারোগ্য ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। তার ক্যান্সার ধরাই পড়েছে এডভান্সড স্টেইজে। মেটাস্টাসিস ছিল ব্রেইনে। দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে জেনে এসেছেন এর নিরাময় সম্ভব না। শুধু প্রশমন চিকিৎসা (Palliative care) চলতে পারে। তখনো লাকী আখন্দ চলাফেরা কথাবার্তায় বাহ্যিকভাবে ঠিক ছিলেন। গত অক্টোবরেও উনাকে দেখেছি রাতের বেলা বংগবন্ধুর (পিজি হাসপাতাল) নিচে উনি গল্প করছেন উনার বিখ্যাত গায়ক বন্ধুদের সাথে।

ক্রমশ তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। শরীর ভেংগে পড়ে। ব্রেইনে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার দরুন উনি বাহ্যজ্ঞান হারাতে থাকেন। কথা বলেন অগোছালো। আমি মাঝে মাঝেই উনাকে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগে দেখতে যেতাম। আমারই হাসপাতালে উনি আছেন দেখতে যাবোনা! স্মৃতি হিসেবে কিছু ছবিও তুলেছিলাম অনুমতি নিয়ে। কিন্তু সেগুলো পোস্ট করা হয়নি।

দুটো কারণে পোস্ট করিনি।
একজন সেলিব্রেটির এরকম রোগ জর্জর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের পক্ষপাতি আমি নই। সত্যি সেই ছবি হৃদয়বিদারক।

দ্বিতীয়ত আমাকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে ইতোমধ্যে ফান্ড কালেকশন শুরু হয়ে গেছে যার সাথে তাঁর চিকিৎসার কোন সম্পর্কই নেই। অসুস্থ ছবি পোস্ট হলে ঐ টাকা তুলে খেয়ে ফেলা অসুস্থ মানুষেরা আরো উদ্যম পেয়ে যেত।

যারা নিয়মিত আমার টাইম লাইনে আসেন তাঁরা দেখে থাকবেন আমি এ নিয়ে একটা স্ট্যটাসও লিখেছিলাম। সেখানে আমার এক আত্মীয় বলেছেন কানাডায় নাকি একটা কন্সার্টও হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
অথচ লাকী আখন্দের সে সময় চিকিৎসা ব্যয় বলতে তেমন কিছুরই দরকার ছিলনা। উনি ছিলেন পুরোপুরি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অধীনে।

আমাদের মেনে নিতে হবে মৃত্যু অনিবার্য। রোগের কাছেও আমরা অসহায়। সব রোগ ভাল হয়না। মানব জাতি জ্ঞান বিজ্ঞানে যত অগ্রসর হবে ততই সে এই সত্য আবিষ্কার করবে নতুন নতুন ভাবে।
লাকী আখন্দের পরিবার তাঁর চিকিৎসা নিয়ে সম্ভাব্য সবরকম ধৈর্য, সহযোগিতা, সুসিদ্ধান্ত বজায় রেখেছেন। অন্য অনেক সেলিব্রেটির মত অহেতুক অতিষ্ট করে তোলেননি। মিডিয়াকেও বাণিজ্য করার তেমন সুযোগ দেননি। প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগে অন্য পাঁচটা রোগীর সাথেই তিনি ছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসা নিয়েও উৎকট বাণিজ্য হয়েছিল। আরোগ্য সমিতি গঠন করে, ব্যাপক হুলস্থুল করে সেই সমিতি কবির পরিবারকে এক হাজার টাকা আর ডাক্তার বিধান রায়কে একবেলা কবির বাড়িতে এনেছিলেন। সব্যসাচীর স্মৃতি চারণে আমরা সেটা জানতে পারি। সেই সমিতির জনৈক কর্তাব্যাক্তি পরবর্তীতে কবির চিকিৎসার জন্য উঠানো টাকা মেরে দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা এসে তিনি জায়গা কেনেন এবং অসুস্থ নজরুলকে নিয়ে ' যেমন দেখেছি' টাইপ বই লিখে সাহিত্যামোদী মহলে আদর কুড়িয়েছেন। আমরা অবাক হবনা যদি দেখি সেই লেখক পরবর্তীতে বাংলা একাডেমী বা এ জাতীয় রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

লাকী আখন্দ প্রসংগে আসি। লাকী আখন্দের চিকিৎসা যথাযথ হয়েছে, যা করা যেত তাই হয়েছে। এক পর্যায়ে প্যালিয়েটিভ কেয়ার থেকে উনি বাসায় চলে গেছেন। সেটাও চিকিৎসকের পরামর্শেই। সেখানে নিকটজনদের সান্নিধ্যে তিনি শেষদিনগুলি কাটিয়েছেন।

জীবদ্দশায় তিনি যথেষ্ট সেলিব্রেশনই পেয়েছেন। পারিবারিক ভাবেই স্বচ্ছল ছিলেন। নিজেকে কোনদিন অসচ্ছল ভাবেননি। উনার মূল্যায়ন হয়নি এটাও বলা যাবেনা। আমাদের গণমাধ্যম, চলচ্চিত্র, ভিজ্যুয়াল মিডিয়া তাকে সব সময় মর্যাদার সাথেই উপস্থাপন করেছে বলে আমি মনে করি। ঢালাও ' মূল্যায়ন হইলনা' বলার কোন কারণ অন্তত আমি দেখিনা।

লাকী আখন্দ সিংগাপুরের কোন হাস্পাতালে মারা গেলে হয়ত এই কথাগুলো আসতোনা। আমদের অনেক মহান শিল্পীও এরকম অযৌক্তিক চিন্তায় আক্রান্ত। আমরা দেখেছি লিম্ফোমার মত রোগের চিকিৎসার জন্য দেশবাসীর সাহায্য নিয়ে অনেকেই সিংগাপুর এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। ৬০ হাজার টাকার চিকিৎসা করিয়েছেন ৬০ লাখে। যার হয়ত কোন দরকারই ছিলনা।

হয়ত আরো কিছু দিতে পারতেন। সেটা আপেক্ষিক। উনি নিজেও অধিক উৎপাদনে বিশ্বাসী ছিলেননা। এদেশের সাংষ্কৃতিক অংগনেই সামগ্রিক একটা দৈন আছে। উনি খেয়োখেয়িতে যেতে চাননি। নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন ভাই হ্যাপী আখন্দের মৃত্যুর পর।

এটা ঠিক আমরা উনাকে মূল্যায়ন করেছি তার কিছু পপ গান দিয়ে। তাঁর ক্ল্যাসিক সুর গুলো নিয়ে আমরা সচেতন ছিলাম না। সেটা নতুন কোন সমস্যা না। শ্রোতা হিসেবে আমাদের মূর্খতা তো আছেই। উনি নিজেও তো সেগুলোকে তাঁর সৃষ্টি হিসেবে হাইলাইট করেননি।

এখনো যে জীবিত বড় শিল্পীরা আছেন তাদের প্রকৃত মূল্যায়নে আমরা সচেষ্ট কি? লাকী আখন্দ কেন সাকিব আল হাসানের মত টাকা পয়সা কামালেননা সেই চিন্তায় না গিয়ে আসুন আমরা প্রতিভার মূল্যায়ন করি মর্যাদা দিয়ে,চর্চা দিয়ে। শিল্পের মূল্যায়ন টাকা পয়সায় হয়না। বরং শিল্প অর্থের অনর্থে অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

___________________________

লেখক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল । রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা।

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়